স্টাফ রিপোর্টার::
পরিবেশগত বিবেচনায় দেশের ৫১টি পাথর কোয়ারীর মধ্যে সিলেটের ৬টিসহ মোট ১৭টি পাথর কোয়ারির ইজারা স্থগিত রাখার প্রতিবাদে সোমবার (২৮ এপ্রিল) দুপুরে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার টুকের বাজার মেজবান রেষ্টুরেন্ট এন্ড পার্টি সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য শওকত আলী বাবুল। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, প্রায় ১২ বছরের ফ্যাসিস্ট আমলে সিলেটের লাখো মানুষের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম পাথর কোয়ারি সমুহ বন্ধ রাখা হয়েছিল। ভারতীয় আগ্রাসন তথা ভারতের পাথর বিপননের স্বার্থে পরিবেশ ক্ষতির দোহাই দিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পাথর আহরণ বন্ধ করে দেয়ার ফলে সিলেটের মানুষের জীবন জীবিকায় ভয়াবহ অনিশ্চয়তা নেমে আসে। কোয়ারি বন্ধ করার ফলে নিমিষেই লাখ লাখ মানুষ অবর্ননীয় দুঃখ কষ্টে নিপতিত হয়।এলাকায় অভাব অনটন এবং সংকট হয়ে পড়ে মানুষের নিত্য সঙ্গী। সিলেটের প্রান্তিক জনপদে বিরাজ করে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি। বিগত সরকারের মদদপুষ্ট একটি দুষ্টচক্র ও চিহ্নিত সিন্ডিকেটের প্রত্যক্ষ ইশারায় সিলেটের লাখ লাখ মানুষের রোজগারস্থল পাথর কোয়ারি বন্ধ করে দেয়া হয়।কোয়ারি বন্ধ করে এই চক্রটি রিজার্ভের ডলার দিয়ে ব্যাপক ভাবে পাথর আমদানি করে দেশের অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। স্থানীয় পাথর কোয়ারিতে পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় করে পাথর আমদানির ফলে আমাদের অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে । যুগ যুগ ধরে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের সাথে নেমে আসা রাশি রাশি পাথর সংগ্রহ করেই এ অঞ্চলের প্রায় সকল মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতেন।দেশের নির্মাণ শিল্পের অন্যতম উপাদান হিসেবে এ অঞ্চলের পাথর ব্যবহ্নত হয়ে আসছে।
ঢলের তোড়ে নেমে আসা পাথর ও বালি সুষ্ঠু ভাবে আহরণের কারনে নদীর নাব্যতাও বজায় থাকতো যার ফলে এ অঞ্চলে বন্যার ভয়াবহতা দেখা দিতোনা কিন্তু পাথর আহরণ বন্ধ করে দেয়ায় সিলেটের নদীর তলদেশ ভরাট হওয়ার কারনে পানি নিষ্কাশনে মারাত্মক বাঁধার কারনে প্রতি বছর এ অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। ধলাই ও পিয়াইন নদীর উৎসমুখে রাশি রাশি পাথর জমা হওয়ার ফলে ইতিমধ্যে এ অঞ্চলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে ফলে এ অঞ্চলের তীরবর্তী বেশ কয়েকটি জনপদ যেকোন সময় ঢলে নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। অথচ নদীর উৎসে স্তুপকৃত পাথর অপসারণ করা হলে এ অঞ্চলের মানুষ বন্যা ও ঢলের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতো।সিলেটের পাথর কোয়ারি যখন চালু ছিল তখন এ অঞ্চলের মানুষের রোজগার ও সমৃদ্ধি ছিল ব্যাপক।এ অঞ্চলে শত শত কোটি টাকা পাথর ব্যবসায় বিনিয়োগ করে লাখ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতেন এছাড়া লাখ লাখ বারকি শ্রমিক পাথর আহরণ করে তাদের পরিজন নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন অতিবাহিত করতেন কিন্তু কোয়ারি বন্ধ করে দেয়ায় এসব মানুষগুলো এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন।কোটি কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা কর্মক্ষেত্র হারিয়ে আজ দেউলিয়া হয়ে ঋণ খেলাপীর দায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সত্যিকারার্থে কর্মহীন এই জনপদে তাই বিরাজ করছে মারাত্মক সংকটাপন্ন অবস্থা। আধিপত্যবাদি ভারতের স্বার্থে কোয়ারী বন্ধ করে দিয়ে পাথরের চাহিদা মেটাতে বিগত সময়ে বাংলাদেশের প্রায় সকল সীমান্ত দিয়ে আমদানি করা হয় ভারতীয় নিম্নমানের চুনাপাথর।রিজার্ভের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ভারতে পাচার করে তার বিনিময়ে নিম্নমানের পাথর এনে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়।এইসব অবকাঠামোর ভবিষ্যৎ স্থায়িত্ব মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।পাথর আমদানির নামে ঢালাও ভাবে রিজার্ভের ডলার ব্যায় করার ফলে আমাদের কেন্দ্রীয় রিজার্ভের অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌছে ছিলো তা আপনারাই ভালো বলতে পারবেন, অথচ আমাদের কোয়ারীতে রয়েছে উন্নতমানের পাথর যার সঠিক উত্তোলন এবং ব্যবহার করা হলে একদিকে আভ্যন্তরীণ সম্পদ দিয়ে আমাদের চাহিদা মেটানো সম্ভব হতো এবং অন্যদিকে আমাদের রাষ্ট্রের রিজার্ভের ডলার অপচয় রোধ হতো।তিনি আরো বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা দরবেশ বাবা এবং আরও ভয়ঙ্কর মাফিয়া সিন্ডিকেটের স্বার্থে এবং ভারতের চক্রান্তে মূলতঃ পাথর কোয়ারী সমূহ বন্ধ রেখে আমাদের অর্থনীতির অপূরনীয় ক্ষতি সাধন করা হয়।আওয়ামীলীগের পতন এবং হাসিনা পলায়নের পর দেশে বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সময়ে আমরা আশায় বুক বেঁধে ছিলাম যে হয়তো এই সময়ই লাখো মানুষের কর্মসংস্থান পাথর কোয়ারি খোলা হবে।আপনারা ইতিমধ্যে অবগত আছেন সরকারের খনিজ মন্ত্রণালয়ের উচ্চতর কমিটির সুপারিশে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পাথর কোয়ারি সমূহ খোলে দেয়ার ব্যাপারে সুপারিশ ব্যক্ত করা হয়। যথাযথ ইজারা কার্যক্রমের মাধ্যমেই পাথর কোয়ারি খোলার সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হলে আমরা তথা এ অঞ্চলের লাখো মানুষ আশায় বুক বাঁধি।অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা মাফিয়া সিন্ডিকেট এবং ভারতীয় এজেন্টদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদ পরিবেশের দোহাই দিয়ে পাথর কোয়ারীর ইজারা কার্যক্রম স্থগিত করেছে। উপদেষ্টা পরিষদের এই দেশবিরোধী হটকারী সিদ্ধান্ত আমাদেরকে কেবল হতবাকই করে নাই, এই সিদ্ধান্তে আমরা অত্যন্ত মর্মাহত এবং ব্যথিত হয়েছি।পাথর সংশ্লিষ্ট জীবিকা নির্বাহের আশায় অপেক্ষারত এ অঞ্চলের লাখো মানুষ উপদেষ্টা পরিষদের এ সিদ্ধান্তে মারাত্মক হতাশ ও ক্ষুব্ধ উপদেষ্টা পরিষদে ঘাপটি মেরে বসে থাকা দেশবিরোধী মাফিয়াদের ইন্ধনেই এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি অথচ যথাযথ ইজারা কার্যক্রমের মাধ্যমে কোয়ারী সচল করলে সরকার প্রতিবছর কয়েকশ কোটি টাকার রাজস্ব প্রাপ্তি ছাড়াও পাথর আমদানি বন্ধ হলে সাশ্রয় হতো বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভের টাকা একটা অঞ্চলের মানুষকে তাদের ন্যায্য রোজগার থেকে বঞ্চিত রেখে কখনোই একটা দেশের উন্নয়ন আশা করা যায়না।. আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম পাথর আহরণ, আমরা সরকারের নিকট দাবি জানাচ্ছি – অবিলম্বে পাথর কোয়ারি খুলে দিয়ে লাখো মানুষকে বাঁচার সুযোগ দিন। অন্যতায় আমরা নিয়মতান্ত্রিক ভাবে পুনরায় আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবো। বিগত সরকারের আমলে আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দেলন চালাতে গিয়ে সরকারের সিন্ডিকেট ও প্রশাসন কর্তৃক ব্যাপক ভাবে হয়রানি ও নাজেহালের শিকার হই। এখন দেশ থেকে ফ্যাসিবাদ দূর হয়েছে, সিন্ডিকেট নামক অপশক্তিও পালিয়েছে। আমরা চাই সুশাসনের এই ঊষালগ্নে সিলেটের লাখো মানুষের জীবন ও জীবিকার পথ সুগম করতে অবিলম্বে পাথর কোয়ারি সমূহ থেকে পাথর আহরনের সুযোগ দেয়া হোক। অবিলম্বে ইজারা দিয়ে সিলেটসহ ১৭টি পাথর কোয়ারি সচল করা না হলে আমরা বৃহত্তর সিলেটবাসীকে নিয়ে সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দিতে বাধ্য হবো। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পাথর ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি আবুল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক জসিমুল ইসলাম আঙ্গুর, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ষ্টোন ক্রাশার মিল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল জলিল, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হেকিম, ভোলাগঞ্জ চুনাপাথর আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি সাহাব উদ্দিন, সহ-সভাপতি বশির আহমদ, ব্যবসায়ী আব্দুল আজিদ, মতিউর রহমান, ইলিয়াছুর রহমান, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি কবির আহমদ, সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মাহফুজ প্রমুখ। আরো উপস্থিত ছিলেন পাথর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। উল্লেখ্য, গত রোববার (২৭ এপ্রিল) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সভাপতিত্বে সারা দেশের গেজেটভুক্ত পাথর/সিলিকাবাল/নুরী পাথর/সাদা মাটি কোয়ারীসমূহের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
পরিবেশগত বিবেচনায় দেশের ৫১টি পাথর কোয়ারীর মধ্যে ১৭টি পাথর কোয়ারির ইজারা প্রদান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষিত কোনো পাথর কোয়ারীতে ইজারা প্রদান করা যাবে না। এ ছাড়াও নৈসর্গিক সৌন্দর্য রক্ষার স্বার্থে সিলেট জেলার ভোলাগঞ্জ, উৎমা ছড়া,রতনপুর, বিছানাকান্দি, লোভা ছড়া ও শ্রীপুর পাথর মহালে ইজারা প্রদান কার্যক্রম স্থগিত থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। সভায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও স্বরাষ্ট্র এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এসময় উপস্থিত ছিলেন।