ছাইদুর রহমান নাঈম, কিশোরগঞ্জ থেকে
চারদিকে খাঁ খাঁ রোদ৷ যতদূর চোখ যায় কোন গাছের ছায়া নেই৷ তীব্র রৌদ্রময় খরতাপে মাঠে কাজ করা শ্রমীকদের মাথার ঘাম বৃষ্টির পানির মতো বেয়ে শরিলে পড়ছে৷ দেখলে মনে হবে এখনই পানি থেকে ডুব দিয়ে বুঝি ওঠলো৷ আবার আকাশে চরম বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে যাওয়ার তো যায়গা নেই৷ ঝড়বৃষ্টিতে ভেজা ছাড়া রক্ষা নাই৷ চোখের সামনে তীব্র বজ্রপাতের শব্দ যেনো মৃত্যুর হাতছানি৷
মাঝেমধ্যেই বজ্রপাতে মাঠে কাজ করা শ্রমীকদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এই মৃত্যুও যেনো তাদের নির্মম নিয়তি৷ এভাবেই রোদবৃষ্টিতে আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে তিনবার খাবারের জন্য৷ জীর্ণ শীর্ণ শরিল আর রোগশোক নিয়ে জীবন সংগ্রাম করা এসব শ্রমজীবী মানুষেরা পরিবারের মুখে তিনবার খাবার তুলে দিবার সংগ্রাম করছে প্রতিনিয়ত।
কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলে কাজ করা হাজার হাজার শ্রমিকদের এমন অবস্থা বছরের প্রায় সবসময়ই। শুকনো সময় ৬ মাস হাওরে আর বর্ষায় ৬ মাস অনিশ্চিত অন্য কোন কাজের সন্ধানে ছুটতে হয়৷
সরেজমিনে জেলার নিকলী ও বাজিতপুর উপজেলার হুমাইপুর হাওরে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়। এসময় প্রায় অর্ধশত শ্রমজীবী মানুষের সাথে কথা হয় বাংলাভূমির প্রতিবেদকের সাথে।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থেকে ১৫ সদস্যের দল গত বর্ষার শেষে এসেছে হাওরে৷ আমন ধান রোপণ করা থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তোলার কাজ করার চুক্তিতে৷ দলনেতা উসমান মিয়া (৫৫) বলেন, আমাদের জিবন হইলো যাযাবর৷ খোলা আকাশের নিচে কোন রহম থাকি৷ বাড়ির সবার মুহে তিনবার খাউন দিলেই খুশি৷ পরিবারের সবার মুখ না দেইখা বন্দে বন্দে ( মাঠে) পইরা রই৷ সরকার আমাদের জন্য কাম বাইর করতো তাইলে অতো কষ্ট হইতো না৷ বাড়িছাড়া থাহা খুব কষ্টের৷ দেশে থাইক্কাই যেন পরবাসী৷
নিকলীর ছাতিরচর হাওরে কথা হয় একাধিক ধান কাটা শ্রমিকের সাথে৷ তাদের মধ্যে আব্দুল কাদির (৪৫) আহমেদ মিয়া (৬৫) সবুজ (২৫) জানান, মেশিনের সাথে তারা ধান কাটতে পারছেনা৷ ফলে তাদের কাজ অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ সরকারের নিকট তাদের দাবি, বেকার শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার৷ অন্তত কাজ করে তিনবেলা খেয়ে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা চায় তারা৷ তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, এসিরুমে বসে কি তাদের কষ্ট কেউ অনুধাবন করতে পারবে?।
আবু সায়িদ (৪৭) মফিজ মিয়া (৩৭) বলেন, আমাদের শরিলডার মধ্যে কতো রোগের বাসা বেঁধেছে কইতারতাম না৷ চিকিৎসা কেমনে করুম। ডাক্তারের কাছে গেলে এই পরীক্ষা হেই পরিক্ষা দিয়া ৩ হাজার টেহা খরচ করে৷ চিকিৎসা বড়লোকের জন্য। আল্লাহ এমনে বাঁচাইলে বাঁচবো নাইলে মরবাম। সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু আমাদের শ্রমিকদের নিয়া কেউ উদ্যোগ নিলোনা৷
জিরাতি শ্রমিক
হাওরে অন্য এলাকা থেকে কাজের জন্য এসে ৬ মাস অবস্থান করে৷ কৃষকের তৈরি বন দিয়ে ঝুপড়ি ঘরে থেকে ফসল রোপণ থেকে শুরু করে কাটার আগ পর্যন্ত যেসব শ্রমিকরা থেকে কাজ করেন তাদেরকে জিরাতি শ্রমিক বলা হয়ে থাকে৷ অন্য এলাকা থেকে আগতরা ছাড়াও স্থানীয় শ্রমিক কৃষক মিলে ৩০-৫০ হাজার মানুষ অস্থায়ী ঘরে বসবাস করেন। দেশের অনেক এলাকা থেকে তারা এসে কঠোর পরিশ্রম করেন। ছোট্ট কুঁড়েঘরে বসবাস করা জিরাতিরা ঘরের মাচায় স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে ঘুমান। মাচার নিচেই রাখা হয় গবাদি পশু। চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বসবাস করা এসব মানুষের ভাগ্যে জোটে না পুষ্টিকর খাবার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মোটা ভাত আর মরিচ ভর্তা কিংবা পান্তা ভাত দিয়ে চলে খাবার। নেই বিশুদ্ধ পানীয়জলের ব্যবস্থা।
প্রাকৃতিক কাজ সারতে হয় খেতের আলে। আছে শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাতসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা। তবে এ সবকিছু তুচ্ছ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কৃষকরা বছরের ছয়টি মাস পড়ে থাকেন হাওরে। নিজেদের ঘরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন ফেলে কার্তিক মাসে তারা পাড়ি জমান হাওরে। জমি তৈরি করা, চারা রোপণ, সেচ, পরিচর্যা থেকে শুরু করে ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই শেষে নতুন ধান সঙ্গে নিয়ে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে বাড়ি ফেরেন জিরাতিরা। ফলন ভালো হলে তাদের মুখে হাসি ফোটে। ভুলে যান পেছনের দুঃখ-কষ্ট। আবারও প্রস্তুতি নেন পরের বার হাওরে যাওয়ার।
বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ এভাবেই চলছে জিরাতিদের জীবনচক্র! বাপ-দাদা থেকে শুরু করে তাদেরও আগের বংশধররা এভাবেই চালাচ্ছেন নিজেদের কৃষিকাজ। কিন্তু নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এই খাদ্য সৈনিকদের খবর নেয় না কেউ। তাদের জিরাতিকালে জীবনমান উন্নয়ন কিংবা সামান্য পানীয়জল আর স্যানিটেশন নিশ্চিত করা হলে দেশের জন্য তারা আরো বেশি অবদান রাখতে পারবেন
দাওয়াল
হাওরে ধান কাটার মৌসুমে যেসব শ্রমিকরা বিভিন্ন এলাকা থেকে আসেন তাদেরকে দাওয়াল বলা হয়। তারা দলবেঁধে এসে চুক্তিভুক্ত হয়ে জমির ধান কেটে থাকেন৷ কেউ ধানের বিনিময়ে আবার কেউ টাকার বিনিময়ে কাজ করেন৷
যে কারণে উৎকণ্ঠা
বর্তমানে কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যাবহার বাড়ছে। আধুনিকতার প্রয়োগে এগিয়ে যাচ্ছে কৃষি ও কৃষক। ফলে যান্ত্রিকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ৷ দেশ এগিয়ে গেলেও শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে না যতটা প্রয়োজন৷ ফলে এটা নিয়েই যতটা দুশ্চিন্তা শ্রমজীবী মানুষের৷ তারা প্রযুক্তির ব্যবহার ও সুফল বিষয়ে একমত৷ ধীরে ধীরে শ্রমজীবী মানুষের টিকে থাকার পথগুলো সংকুচিত হচ্ছে৷ হাওর অঞ্চলে এসেছে হারভেষ্টর মেশিন৷ দ্রুত সময়ের মধ্যে ধান কেটে দিচ্ছে৷ শ্রমীকদের থেকে এটার খরচও কম বলছে কৃষকরা৷ ফলে কমেছে শ্রমিকের চাহিদা।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান জানান, বর্তমান সরকার শ্রমিকদের জন্য নানান উদ্যোগ হাতে নিচ্ছে৷ এ বিষয়ে দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে সরকার শ্রমজীবী মানুষের পাশে থাকবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শ্রমজীবী মানুষের অবদানকে আমাদের সবারই মর্যাদা দিতে হবে৷