* ডিএনসি কর্মকর্তা সানোয়ারের বিরুদ্ধে নিরীহদের ফাঁসানো ও অর্থ আদায়ের চাঞ্চল্যকর তথ্য
* মামলার এজাহার আর চার্জশিট ও মামলার সাক্ষীর বক্তব্যে বিস্তর ফারাক
* তদন্ত প্রক্রিয়া ফৌজদারী কার্যবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন
* এজাহার মানেই চার্জশিট, এটি যেন প্রশাসনিক প্রথা, তদন্ত কেবল নামমাত্র
বিশেষ প্রতিবেদক:
কক্সবাজার শহরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)-এর কর্মকর্তাদের অভিযানের আড়ালে ঘুষ ও জালিয়াতির ভয়াবহ চিত্র প্রকাশ পেয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা ‘ফিটিং বাণিজ্য’ নামে পরিচিত একটি কৌশলের মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো সহ অর্থ আদায় করছেন। সম্প্রতি এমনই এক ঘটনায়, আসামির হাতকড়া খুলে দেওয়ার সময় ঘুষ লেনদেন নিয়ে প্রতিবাদ জানান শহরের কুতুবদিয়া পাড়ার বাসিন্দা নুর মোহাম্মদের ছেলে রফিকুল ইসলাম (২৫)। তবে এই প্রতিবাদের জেরেই ডিএনসি-র এসআই মো. সানোয়ার হোসেন তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে মাদক মামলার আসামি করে দেন।
অনুসন্ধানে, গত বছরের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কক্সবাজার শহরের কলাতলি কাঁচাবাজারের পাশে পরিচালিত একটি নাটকীয় অভিযানে উঠে এসেছে ঘুষ ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
ঐ অভিযানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আজিম আলীর ছেলে ইয়াসিন (৪১)কে ইয়াবাসহ আটক করেন এসআই সানোয়ার হোসেনের নেতৃত্বাধীন একটি টিম। অভিযানের সময় ঘটনাস্থলের আশপাশে উপস্থিত ছিলেন মহেশখালীর বাসিন্দা গোলাম ছোবহানের ছেলে মোস্তফা শাহরিয়ার (২৭) ও একই উপজেলার মৃত ফজল আহমদের ছেলে গোলাম রহমান বাপ্পি (২৫)। অভিযুক্ত আভিযানিক দল তাঁদেরকেও ‘সহযোগী’ আখ্যায়িত করে আটক করে। এরা দুজনের বর্তমান ঠিকানা কক্সবাজার শহরের কলাতলির সুলতানপুর এলাকায়। আটক তিনজনকে কলাতলি কাঁচাবাজারের পাশ থেকে সিএনজি যোগে ডিভাইন রোডের ভেতরে অন্ধকার স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা আদায়ের ধর কষাকষি করেন।
আটক বাপ্পির মা, শাহ মারুফ বেগম জানান, তাঁর ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য প্রথমে ৫ লক্ষ টাকা দাবি করেন এসআই সানোয়ার। পরবর্তীতে অনুরোধ-উপরোধ ও নগদ, বিকাশ ও এটিএম থেকে মোট ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। তারপরও এসআই সানোয়ার সন্তুষ্ট হননি। শেষ পর্যন্ত ঘরের ‘মাটির ব্যাংক’ ভেঙে যা কিছু ছিল সব দিয়ে ছেলেকে হাতকড়া থেকে মুক্ত করতে হয়।
ঘটনার সময় ওশান প্যারাডাইজের সামনে থেকে আটককৃত দের পরিবারের আহাজারি দেখে রফিকুল ইসলাম ঘুষ বানিজ্যের তথ্য জেনে যায়। ঘন্টাখানেক পরে আটককৃত ঐ তিনজনকে ডিভাইন রোড থেকে কলাতলী বাজারের পাশে আবার নিয়ে আসেন এসআই সানোয়ার ও তার টিম। এ সময় সহযোগী হিসাবে আটক করা দুই জনকে হাতকড়া খুলে দেওয়ার মূহুর্তে সরব প্রতিবাদ জানিয়ে রফিক প্রশ্ন তোলেন, “ঘুষ নিয়ে আটককৃতদের কেন ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে?” এই প্রশ্ন তোলার পরপরই এসআই সানোয়ার হোসেন রফিকুলের ওপর চড়াও হন। লোকচক্ষুর সামনে ঘটনাটি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ইয়াসিন ও বাপ্পি, শাহরিয়ারদের সাথে রফিকুলকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ডিএনসির কক্সবাজার কার্যালয়ে। অভিযানের সময় ঘটনাস্থল থেকে স্থানীয় মোবাইল দোকানদার মো. আলমগীর (৩১), পিতা: মো. আবুল বশর এবং বাদাম বিক্রেতা পরীক্ষিত ধর (৫২), পিতা: মৃত অনিল ধর, এই দুইজনকে জোরপূর্বক খালি মুচলেকার ফরমে স্বাক্ষর করানো হয়। যা আইনানুযায়ী ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭০(২) ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যদিও এসআই সানোয়ার দাবি করেন, এই স্বাক্ষরগুলো মুচলেকা হিসেবে নয়, শুধুমাত্র জব্দ তালিকার অংশ হিসেবেই নেওয়া হয়েছে।
পরদিন ২৫ নভেম্বর কক্সবাজার সদর মডেল থানায় এসআই মো. সানোয়ার হোসেন ঘটনার সময় রাত ৯টা উল্লেখ করে মামলা নং-৫৫(১১)২৪ দায়ের করেন। মামলায় ৪ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধারের কথা উল্লেখ করা হয় এবং প্রতিবাদকারী রফিকুল ইসলামেরসহ মোট ৩টি মোবাইল ফোন ও ৬টি সিমকার্ড জব্দ দেখানো হয়। রফিকুল ইসলামকে ১নং আসামি করে তার প্যান্টের পকেট থেকে ২ হাজার পিস ইয়াবা এবং রোহিঙ্গা ইয়াছিনকে ২নং আসামি করে তার কাছ থেকেও ২ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধারের কথা বলা হয়। অর্থের বিনিময়ে হাতকড়া খুলে ছেড়ে দেওয়া বাপ্পি ও শাহরিয়ারকে সহযোগী হিসেবে ৩নং ও ৪নং আসামি করা হয়।
এছাড়া, মামলায় পাবলিক স্বাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করা হয় চট্টগ্রামের চাঁদগাঁও থানার বাসিন্দা মো. আবুল বশরের ছেলে মো. আলমগীর (৩১) ও রামুর রাজারকুল এলাকার মৃত অনিল ধরের ছেলে পরীক্ষিত ধর (৫১)-কে। তারা দুজনই ঘটনাস্থল কলাতলি এলাকার মোবাইল দোকানদার ও ফুটপাতের বাদাম বিক্রেতা।
তবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী মোবাইল দোকানদার মো. আলমগীর ও বাদাম বিক্রেতা পরীক্ষিত ধর জানান, ঘটনার দিন পুলিশ তাদের দিয়ে খালি একটি ফরমে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। তাদের দাবি, তারা তদন্তের সময় কখনোই মামলার এজাহারে উল্লিখিত বক্তব্য কিংবা জবানবন্দিতে উল্লেখিত বক্তব্য দেননি। বরং পুলিশের কাছে আগেই নেওয়া স্বাক্ষরের ভিত্তিতে তাদের বক্তব্য সাজিয়ে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই বিষয়ে এসআই সানোয়ার দাবি করেন, “সাক্ষীরা সবসময় সঠিক কিংবা সত্য কথা বলবেন, তা আশা করা যায় না।”
পরবর্তীতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জীবন বড়ুয়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও, সাক্ষীদের প্রকৃত বক্তব্য না নিয়ে, আগে থেকেই নেওয়া খালি ফরমে থাকা নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬১ ধারার অধীনে পুলিশের এজাহারের বক্তব্য হুবহু লিখে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। যা আইন অনুযায়ী ১৬১ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং এতে তদন্ত প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে তদন্তক কর্মকর্তা এসআই জীবন বড়ুয়া দাবি করেন, তিনি সাক্ষীদের কাছ থেকে মুচলেকায় স্বাক্ষর নিয়েছেন এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেছেন। তবে সাক্ষী মো. আলমগীর জানান, ঘটনার কয়েকদিন পর পুলিশ তার সাথে দেখা করলেও কোনো ধরণের স্বাক্ষর নেয়নি এবং জবানবন্দিতে যেভাবে তার বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি তেমন কিছু বলেননি। অপর সাক্ষী, বাদাম বিক্রেতা পরীক্ষিত ধর জানান, ঘটনার দিন তিনি পুলিশের উপস্থিতি দেখেছেন ঠিকই, কিন্তু এরপর থেকে আর কোনো পুলিশ কর্মকর্তা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।
এছাড়া সাক্ষী মো. আলমগীর ও বাদাম বিক্রেতা পরীক্ষিত ধর জানিয়েছেন, ঘটনার সময় তাদের উপস্থিতিতে কোনো মাদক গণনা করা হয়নি। এমনকি ইয়াবার প্রকৃত পরিমাণ নিয়েও পুলিশ বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছে। পরীক্ষিত ধর আরও বলেন, অভিযানের সময় রফিক নামের এক ব্যক্তি পুলিশের উদ্দেশে প্রশ্ন তোলেন, “ঘুষ খেয়ে ধরা লোকজনকে ছেড়ে দিচ্ছেন কেন?” এমন প্রতিবাদের জেরে তার সঙ্গে পুলিশের তর্ক হয় এবং একপর্যায়ে বাকিদের সাথে রফিককেও টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
পরিশেষে দেখা যায়, মামলার এজাহার ও চার্জশিটে একই ধরনের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, অথচ সাক্ষীদের বক্তব্যে রয়েছে বড় ধরনের ফারাক। এতে স্পষ্ট হয়, “এজাহার মানেই চার্জশিট” যেন প্রশাসনের এক ধরনের প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে তদন্ত চলে কেবল নামমাত্র।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, যদি রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে কোনো মাদক উদ্ধার না হয়, তবে তার বিরুদ্ধে উদ্ধার দেখানো ২ হাজার পিস ইয়াবা এলো কোথা থেকে?
স্থানীয় সচেতন মহলের মতে, এসব ঘটনা শুধু সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করে না, বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করে দেয়। দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে, অংশবিশেষ ডিএনসি কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যরা মাদক উদ্ধার দেখিয়ে অর্থ গ্রহণ করেন, এরপর সেই মাদক আবার কারবারিদের কাছে বিক্রি করেন অথবা নিরীহ মানুষকে ফাঁসানোর জন্য সংরক্ষণ করেন।
সর্বপরি মামলার বাদী এসআই সানোয়ার হোসেন ও তদন্ত কর্মকর্তা জীবন বড়ুয়া জানিয়েছেন- অভিযানের সময় ও তদন্তকালীন যে তথ্য পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতেই মামলা রেকর্ড ও চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। তবে ভুক্তভোগী রফিকুল ইসলামের দাবি, “মাদক সংক্রান্তে আটক আসামিকে অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে হাতকড়া খুলে ছেড়ে দিতে দেখে আমি প্রতিবাদ করি। এরপরই আমাকে আটককৃতদের সাথে মিথ্যা মাদকের ফিটিং মামলায় ফাঁসানো হয়।” তিনি আরও জানান, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে তার কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়। সেই সাক্ষাৎকালে গোপনে ধারণ করা কথোপকথনে তাকে ফাঁসানোর বিষয়টির সত্যতা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
এই বিষয়ে কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) সহকারী পরিচালক মো. সিরাজুল মোস্তফার মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। ফলে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
স্থানীয়রা জোর দাবি তুলেছেন, রফিকুল ইসলামদের মতো প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর যাতে ‘মাদক উদ্ধার নাটক’ এর শিকার না হয়, সেজন্য প্রয়োজন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ। কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে মামলার রেকর্ড হিসাবের বাইরের মাদক উদ্ধার সম্ভব বলেও অভিযোগ রয়েছে।