সোমবার , ১৩ই মে, ২০২৪ , ৩০শে বৈশাখ, ১৪৩১ , ৪ঠা জিলকদ, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > আলবদর প্রধান থেকে মন্ত্রী, অতঃপর ফাঁসির দড়ি!

আলবদর প্রধান থেকে মন্ত্রী, অতঃপর ফাঁসির দড়ি!

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥

ঢাকা: প্রথমে ফরিদপুর, এরপরে ঢাকায়- নানা মাত্রায় নানা ধরনের নৃশংসতম মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। গড়েছেন রাজাকার বাহিনী, ছিলেন কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনীর প্রধান। নিজে জড়িত থেকে এবং রাজাকার, আলবদর ও অবাঙালি বিহারিদের নেতৃত্ব দিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ হত্যা, গণহত্যা সংঘটন করে ঘাতকের কুখ্যাতি পেয়েছেন। সারা দেশে সভা-সমাবেশ করে বক্তৃতা দিয়ে, পত্রিকায় বিবৃতি, প্রবন্ধ, উপ-সম্পাদকীয় লিখে উস্কানি ও প্ররোচনা দিয়েছেন সহযোগী ও অধীনস্থদের।

একাত্তরের সেই ঘাতক, পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধানতম সহযোগী এবং শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে শনিবার (২১ নভেম্বর) মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ ও সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে পাঁচ বছরের বিচারিক কার্যক্রম ও রায়ের ভিত্তিতে রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে এ মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়।

মুজাহিদকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা-গণহত্যা, আটক ও নির্যাতন, ধর্মগত ও রাজনৈতিক কারণে নির্যাতন করে হত্যার মতো বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে। এর মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ফাঁসির দড়িতে ঝোলেন তিনি। পাশাপাশি সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটিতে (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব) থাকা নেতা হিসেবে গণহত্যা সংঘটিত করা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা, ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার মাধ্যমে হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়ন ইত্যাদি ঘটনার দায়ও প্রমাণিত হয় তার বিরুদ্ধে।

আরও তিনটি অপরাধে আদালত যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডাদেশ দিলেও সর্বোচ্চ সাজা কার্যকর হওয়ায় সেসব সাজা ভোগের প্রয়োজন পড়েনি। এর মধ্যে ৫ নম্বর অভিযোগে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ কয়েকজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন এবং ৩ নম্বর অভিযোগে ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট এলাকার (রথখোলা) মৃত রমেশ চন্দ্র নাথের পুত্র রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক ও নির্যাতনের দায়ে ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয় মুজাহিদকে।

যেভাবে আলবদর প্রধান
১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার পশ্চিম খাবাসপুর গ্রামে জন্ম নেন মুজাহিদ। তার বাবা মওলানা আবদুল আলী ছিলেন স্কুল শিক্ষক ও হেকিম। তিনি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগদান করে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। কলেজ জীবনে তিনি ছাত্র সংঘ ও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি ফরিদপুর জেলা ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। এরপর তিনি ঢাকায় চলে যান। ১৯৭০ সালে মুজাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।

সে বছরই তিনি ঢাকা জেলা ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলার শাখার সভাপতি হিসেবে, এরপর জুলাই মাসের ১ম সপ্তাহের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান (অবরুদ্ধ বাংলাদেশ) শাখার সেক্রেটারি হিসেবে এবং সেপ্টেম্বর থেকে এই সংগঠনের প্রাদেশিক সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত আলবদর বাহিনীর ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধান ছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী এবং অক্টোবর থেকে সে বাহিনীর প্রধান হন মুজাহিদ।

রাজাকার বাহিনীর স্থপতি
আলবদর কমান্ডার ছাড়াও মুজাহিদ ছিলেন রাজাকার বাহিনীর অন্যতম স্থপতি। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্র তিনি তার আজ্ঞাবহ রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। ঢাকার ফকিরাপুলে ভাড়া বাসায় থেকে তিনি ফিরোজ মিয়াকে এ বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত করে তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মুজাহিদ ছিলেন এ সংগঠনের সামরিক এবং অর্থনৈতিক মূল চালিকাশক্তি। ফরিদপুর ছাড়ার আগে তিনি স্থানীয় রাজাকার, শান্তি কমিটি, আলবদর ও বিহারিদের নেতৃত্ব দিয়ে সংঘটিত করেন জঘণ্যতম সব মানবতাবিরোধী অপরাধ।

সত্তরের মাঝামাঝি সময় থেকেই ঢাকার ফকিরাপুল এলাকার ভাড়াটিয়া আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা হিসেবে এলাকায় দলের সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতেন। কেন্দ্রীয় সমাবেশে এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে যেতেন। এলাকার ছেলেদের ছাত্রসংঘে যোগদানের ব্যাপারে প্ররোচিত করতেন। একাত্তরের মার্চের পর মুজাহিদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ফকিরাপুলে রাজাকার বাহিনী সংগঠিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজাহিদ ফকিরাপুল ও নয়াপল্টন এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে থাকতেন। তার মধ্যে একটি বাড়ি হলো ৩/৫ নয়াপল্টনের শেখ ভিলা। তবে মুজাহিদের প্রধান আড্ডা ছিল ফকিরাপুল গরম পানির গলিতে ফিরোজ মিয়া ওরফে ফেরু মেম্বারের ১৮১ নম্বর (বর্তমান ২৫৮ নম্বর) বাড়িটিতে। ফিরোজ মিয়াকে এ এলাকার রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত করেন মুজাহিদ।

ফিরোজ মিয়ার বাড়ি সে সময় এলাকার রাজাকারদের প্রধান কার্যালয় এবং সাধারণ বাঙালি ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের ওপর নির্যাতন কেন্দ্রের ভূমিকা পালন করত। এখানে এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির লোকদের ধরে এনে নির্যাতন চালানো হতো। অনেককে সেখানে চোখ বেঁধে নিতে দেখা যেতো এবং নির্যাতিতদের আর্তচিৎকারও শোনা যেতো।

এ বাড়িটি শুধু ফকিরাপুল এলাকার নয়, পুরো ঢাকা শহরের রাজাকারদের অন্যতম ঘাঁটি ছিল। এখানেই অনুষ্ঠিত হতো রাজাকারদের বিভিন্ন সভা, সশস্ত্র ট্রেনিং ইত্যাদি। এখান থেকেই পরিচালিত হতো রাজাকারদের বিভিন্ন অপারেশন, রাজাকার রিক্রুটমেন্ট।

ফিরোজ মিয়া গংয়ের নীতিনির্ধারক ছিলেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তার নির্দেশেই পরিচালিত হতো ফকিরাপুল এলাকার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যাবতীয় তৎপরতা। মুজাহিদের সরাসরি নির্দেশেই পরিচালিত হয়েছে ফকিরাপুল এলাকায় রাজাকার বাহিনীর তৎপরতা, অস্ত্র ট্রেনিং, রিক্রুটমেন্ট ইত্যাদি। তিনি এলাকার রাজাকারদের অস্ত্র-অর্থ সংগ্রহসহ যাবতীয় দুষ্কর্মে সহযোগিতা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি পর্যায়ে এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং স্বাধীনতার পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে অত্যাচার-নির্যাতন, এমনকি হত্যা করার উদ্দেশ্যে গঠিত আলবদর বাহিনীর নেতাও ছিলেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। তবে কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে মুজাহিদের অপতৎপরতা শুধু ফকিরাপুল এলাকায়ই নয়, বিস্তৃত ছিল পুরো ঢাকা শহরে।

মুজাহিদের রিক্রুট ফিরোজ মিয়া ফকিরাপুল এলাকার ৩০০ সদস্যের একটি রাজাকার প্লাটুন গড়ে তোলেন। ফিরোজ মিয়া গং যুদ্ধের সময় ফকিরাপুল ও আরামবাগ এলাকার শত শত বাঙালিকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। নির্যাতন চালিয়েছে এলাকার মেয়েদের ওপর।

শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন হত্যা
মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ছিলেন। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নিজ পত্রিকায় ভাষ্যকার পরিচয়ে ‘ঠগ বাছিতে গা উজাড়’ শিরোনামে এক প্রবন্ধ লিখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এ দেশীয় এজেন্টদের বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর হয়রানির চিত্র তুলে ধরেন।

ওই প্রবন্ধ প্রকাশের পর জামায়াতের দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে ‘অতএব ঠক বাছিও না’ শিরোনামে পাল্টা প্রবন্ধ ছাপা হয়। ওই প্রবন্ধে সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে ‘ভারতের দালাল’ হিসেবে সমালোচনা করা হয়। ওই প্রবন্ধে সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে ‘ভারতের দালাল’ হিসেবে সমালোচনা করা হয়। পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’ এবং ‘ভারতীয় সেনাদের অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে পত্রিকায় লেখার জন্য নির্দেশ ছিল। যেহেতু তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন, তাই তিনি সব সময় ‘দুষ্কৃতকারী’ এবং ‘অনুপ্রবেশকারী’ শব্দ দুটি সিঙ্গেল ইনভারটেড কমার ভেতরে লিখতেন। এ কারণে তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা ও আলবদর বাহিনীর টার্গেটে ছিলেন।

মুজাহিদের বিরুদ্ধে আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে এ অভিযোগ অনুসারে, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ৩টার সময় সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনের ৫ নম্বর চামেলীবাগের ভাড়া করা বাসায় মুজাহিদের নিয়ন্ত্রণাধীন ও পরিচালনাধীন ৭/৮ জন রাইফেলধারী যুবক ঢুকে পড়ে। তাকে তারা নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। তিনি তার নাম সিরাজ উদ্দিন বললে অস্ত্রধারী আলবদররা তাকে ধরে একটি মিনিবাসে অপহরণ করে নিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমনকি মরদেহেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি।

সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ গেরিলা যোদ্ধা হত্যা
আরেক শহীদ বুদ্ধিজীবী সুরকার আলতাফ মাহমুদকে হত্যা করা হয় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কয়েকজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে।

প্রমাণিত এ অভিযোগটি আনা হয়েছিল মুজাহিদের বিরুদ্ধে ৫ নম্বর অভিযোগে। মুজাহিদ যে সেপ্টেম্বর থেকেই শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার হোতা সেটাই প্রমাণ করেছে এ ঘটনা।

অভিযোগ অনুসারে, ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট রাত ৮টায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সে সময়কার সেক্রেটারি আসামি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামীসহ ঢাকার নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলের আর্মি ক্যাম্পে যান। সেখানে তারা আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ এবং গেরিলা যোদ্ধা জহির উদ্দিন জালাল (বিচ্ছু জালাল), বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাদের গালিগালাজ করেন এবং পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে বলেন যে, প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আদেশের আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। আসামি মুজাহিদ অন্যদের সহায়তায় আটকদের একজনকে (বিচ্ছু জালাল) ছাড়া অন্যান্য নিরীহ-নিরস্ত্র বন্দিদের অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ গুমের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন।

ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, হত্যা ঘটনার সময় আসামি উপস্থিত না থাকলেও তার নির্দেশেই নিরস্ত্র-নিরীহ ওই কয়েকজনকে হত্যা করা ঘটেছে বলে প্রমাণ করতে পেরেছেন ট্রাইব্যুনাল। এটিও সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির আরেকটি দায়- রায়ে সেটি প্রমাণিত হয়েছে।

ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবী হত্যা
মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝোলানো ৬ নম্বর অভিযোগে ছিল সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটিতে থাকা নেতা হিসেবে গণহত্যা সংঘটিত করা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা, হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়ন ইত্যাদির ঘটনা এবং বুদ্ধিজীবী হত্যা।

অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। পরবর্তীতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারাও ওই স্থানে ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ অপরাধজনক নানা কার্যক্রম চালায়। এ ক্যাম্পটি ছিল আলবদর বাহিনীর হেডকোয়ার্টার।

আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি (পরে সভাপতি ও আলবদর বাহিনীর প্রধান) হবার সুবাদে আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ছাত্রসংঘের ও আলবদর বাহিনীর সুপিরিয়র নেতা হিসেবে আর্মি ক্যাম্পে উপস্থিত ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আসামি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ১০ ডিসেম্বর থেকে পরিচালিত বুদ্ধিজীবী নিধন অভিযানসহ সারা বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনীসহ হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়ন ইত্যাদিসহ যাবতীয় মানবতবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা সংঘটিত করেন।

একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর গভীর রাত পর্যন্ত অপহরণ করা হয় এদেশের সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীদের। বিজয়ের পরে ১৭-১৮ ডিসেম্বর তাদের কয়েকজনের ক্ষত-বিক্ষত, গলিত-অর্ধগলিত মৃতদেহ উদ্ধার করা হলেও বাকিরা আজও নিখোঁজ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দশজন শিক্ষক, ছয়জন সাংবাদিক ও দুইজন চিকিৎসকসহ ১৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবী অপহরণ, নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মুক্তিযুদ্ধের শেষ সপ্তাহে।

মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে আলবদর হেডকোয়ার্টারে বুদ্ধিজীবীদের নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডে মুজাহিদের উপস্থিতি, অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানের অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে রায়ে।

হিন্দুদের ওপর আক্রমণ ও গণহত্যা
ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ ও গণহত্যার দায়ে চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে মুজাহিদকে।

প্রমাণিত ৭ নম্বর এ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১৩ মে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ করে। শান্তি কমিটির বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বকচর গ্রামের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হামালা চালিয়ে বীরেন্দ্র সাহা, উপেন সাহা, জগবন্ধু মিস্ত্রি, সত্য রঞ্জন দাশ, নিরদবন্ধু মিত্র, প্রফুল্ল মিত্র, উপেন সাহাকে আটক করা হয়। উপেন সাহার স্ত্রী রাজাকারদের স্বর্ণ ও টাকা দিয়ে তার স্বামীর মুক্তি চান। রাজাকাররা সুনীল কুমার সাহার কন্যা ঝুমা রানীকে ধর্ষণ করে। পরে আটক হিন্দু নাগরিকদের গণহত্যা করে। তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। অনিল সাহাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়।

নির্যাতন
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নির্দেশে অনেককে আটক করে হত্যার উদ্দেশ্যে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। ভাগ্যক্রমে অনেকে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন। এদের মধ্যে ফরিদপুরের রণজিৎ নাথ বাবুকে পুরোনো সার্কিট হাউসে ধরে আনা হয়। পরবর্তীতে বিহারি ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়। এ অপরাধে মুজাহিদকে ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের যে কোনো একদিন সকাল বেলা ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালঘাট চামটের (রথখোলা) রমেশ চন্দ্র নাথের পুত্র রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে ধরে আটক করে রাজাকাররা। বেলা আনুমাণিক ১১টার সময় ফরিদপুর পুরোনো সার্কিট হাউসে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সামনে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা মেজর আকরাম কোরাইশীর কাছে হাজির করে তাকে। তখন মুজাহিদ মেজরের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর তার ইশারায় কয়েক রাজাকার ও বিহারি বাবু নাথকে আটক রেখে অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন করে এবং একটি দাঁত ফেলে দেয়।

নির্যাতনের পর মুজাহিদের ইশারায় তাকে হত্যা করার উদ্দেশে বিহারি ক্যাম্পের পূর্বপাশে আব্দুর রশিদ মিয়ার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাজাকাররা আটক করে রাখে। পরে রাতে রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথ তার আটক রাখার ঘরের জানালার শিক বাঁকা করে ঘর থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচান।

আজরাইলের ভূমিকায় মুজাহিদ
মুজাহিদ তার নিয়ন্ত্রিত মুজাহিদ আলবদর বাহিনীকে আজরাইলের কাজ করার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশেই বাংলাদেশের সূর্য সন্তান বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করে বদর বাহিনীর সদস্যরা। ময়মনসিংহের একটি সভায় মুজাহিদ বলেছিলেন, ‘যেখানে মুক্তিবাহিনী, সেখানেই আলবদর। আর যেখানেই মুক্তিবাহিনী সেখানেই আজরালের কাজ করবে আলবদর। মুজাহিদের এই বক্তব্যের মাধ্যমেই তার গণহত্যায় নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন ১৬ ডিসেম্বরও আত্মসমর্পণ করতে চাননি মুজাহিদ। আলবদর বাহিনীকে আত্মসমর্পণ না করে ‘জিহাদ’ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দানসহ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে অস্ত্রও চান মুজাহিদ।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সে সময়ও তার আলবদর বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন মুজাহিদ। তিনি আলবদর বাহিনীর সদস্যদের আত্মসমর্পণ না করে ‘জিহাদ’ চালিযে যাওয়ার নির্দেশ দেন। বিজয়ের দিন ঢাকার আলবদর বাহিনীর হেডকোয়ার্টার থেকে আলবদরদের এক সমাবেশ থেকে তিনি এ নির্দেশ দেন।

এমনকি সেদিন মুজাহিদসহ আলবদর বাহিনীর শীর্ষ ৩ নেতা পাকিস্তানি বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে অস্ত্র দিয়ে সহায়তার আবেদন জানান। সেদিন মুজাহিদ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, আপনারা যেসব অস্ত্রসহ ভারতীয় আগ্রাসনকারীদের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন, সেগুলো আমাদের দিন।

যে ৩ আলবদর সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে অস্ত্র চেয়েছিলেন, তাদেরই একজন আশরাফুজ্জামান খানের (বুদ্ধিজীবীদের প্রধান খুনি) লেখা ‘সানসেট অ্যাট মিডডে’ বইয়ে এ তথ্য দেওয়া রয়েছে।

এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী ও নেতৃত্বদানকারী তথা মূল নায়ক ছিলেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।

আরও অপরাধ
ফরিদপুরের একটি নির্যাতন ও একটি গণহত্যার ঘটনা ঘটলেও মুজাহিদের সম্পৃক্ততা প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেননি বলে রায়ে উল্লেখ করেন ট্রাইব্যুনাল, যার সঙ্গে একমত আপিল বিভাগ। এ দুই অভিযোগ আনা হয়েছিল ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে, যে দুই অভিযোগে খালাস পেয়েছেন মুজাহিদ।

প্রমাণিত না হওয়া ২ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৬ জুলাই সকাল বেলা ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থেকে স্থানীয় রাজাকাররা আবু ইউসুফ পাখি, পিতা-মৃত জয়নাল আবেদীন, সাং-পুর্ব গোয়ালচামট খোদাবক্সপুর, থানা-কোতোয়ালী, জেলা-ফরিদপুরকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে আটক করা হয়। এরপর পাখিকে ফরিদপুর স্টেডিয়াম আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আটক বন্দীদের মধ্যে আবু ইউসুফ প্রকাশ পাখিকে দেখে সঙ্গে থাকা পাক আর্মি মেজরকে কিছু একটা বলার পরই তার উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। সেখানে ১ মাস ৩ দিন আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়। নির্যাতনের ফলে আবু ইউসুফ প্রকাশ পাখির বুকের ও পিঠের হাড় ভেঙ্গে যায়।

১৪ আগস্ট আনুমানিক বেলা ১টার সময় আসামি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ তার সঙ্গীয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের নিয়ে ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালী থানাধীন নীলুটুলিপাড়ার একেএম হাবিবুল হক প্রকাশ মুন্নু, পিতা-মৃত রহমত আলী বিশ্বাসকে হত্যার জন্য তার বাড়িতে হামলা চালানো হয়। সে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে।

প্রমাণিত না হওয়া ৪ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, মুজাহিদ একাত্তরের মে মাসে ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন থানায় বিভিন্ন গ্রামে হিন্দুদের প্রায় তিন শ’ থেকে সাড়ে তিন শ’ বাড়ি পুড়িয়ে দেন। পরে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে ৫০ থেকে ৬০ হিন্দু নর-নারীকে হত্যা করেন।

অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের মে মাস (বাংলা জ্যৈষ্ঠ) এর মাঝামাঝি যে কোন একদিন ভোর আনুমানিক ৬টার দিকে ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন থানার বৈদ্যডাঙ্গী ও বালাডাঙ্গীতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন ও গণহত্যা চালানো হয়। সেখানে গুলি করে যাদের হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে রয়েছেন ননীবালা বিশ্বাস, পিতা-হীরা লাল বিশ্বাস, থানা-চরভদ্রাসন, গ্রাম-বৈদ্যডাঙ্গী, জেলা-ফরিদপুর। নন্দলাল বিশ্বাস, বিজয় বিশ্বাস, চন্দন, অর্জুন বিশ্বাস, প্রফুল্ল বিশ্বাস, রবি বিশ্বাস, কালি চরণ বিশ্বাস, কানন বালা বিশ্বাস, কুটিশ্বর বিশ্বাস, জয়চান ম-ল, পাষাণ বিশ্বাস, তারা চান, বিজয় বৈদ্য, বসন্ত বৈদ্য, অনুকুল বিশ্বাস, মাখন বিশ্বস, মনিরাম বিশ্বাস, নীরদা, ননী বালা, পুন্যা ও অজ্ঞাতনামা ২৯/৩০ জন।

স্বাধীনতার পরেও থামেনি অপকর্ম
আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা ও নৃশংসতা একাত্তরেই শেষ হয়ে যায়নি।

সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ১১ নভেম্বর ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় – ১৯৭৮ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ভিন্নমতাবলম্বী ছাত্রনেতা মওলানা আবদুস সোবহানকে শিবির কর্মীরা কোরআন পাঠরত অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করেন। বিশেষ সূত্রে জানা যায়, এ হত্যা অভিযানের নেতৃত্ব দেন একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় ঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান আলী আহসান মুজাহিদ।

আলবদর প্রধান থেকে মন্ত্রী!
বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হওয়ার পর মুজাহিদ কয়েক বছর আত্মগোপন করে ছিলেন। তবে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মুজাহিদ নারায়ণগঞ্জে পালিয়ে থেকে আদর্শ কিন্ডারগার্টেন নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিন বছর প্রধান শিক্ষক পদে ছিলেন বলে জানা গেছে।

পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে মুজাহিদ পুনরায় রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হন। তিনি ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে চারবারই পরাজিত হন। আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ বর্তমানে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল।

২০০১ সালে তিনি বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী হন, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক ঘটনা হিসেবে গণ্য। ২০০৬ সাল পর্যন্ত মন্ত্রী থাকাকালে অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর নানা নির্যাতন চালান বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে রয়েছে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাও। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম