রবিবার , ১৯শে মে, ২০২৪ , ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ , ১০ই জিলকদ, ১৪৪৫

হোম > Uncategorized > বেশি দামে কেনা হচ্ছে বিদেশি নিম্নমানের কাগজ

বেশি দামে কেনা হচ্ছে বিদেশি নিম্নমানের কাগজ

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: টেন্ডারবাজদের খেয়ালখুশি মতো চলছে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের সব ধরনের কেনাকাটা তাদের ইচ্ছেমতোই চলে। কোটি কোটি টাকা মূল্যের কাগজ কেনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি হয়ে থাকে। টেন্ডারবাজদের কাগজ সরবরাহের কাজ দেওয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার অনেক ক্ষেত্রে অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অধিদপ্তরকে নিম্নমানের দেশি ও বিদেশি কাগজ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।

এতে দেশীয় কাগজশিল্প বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ওই চক্রের দৌরাত্ম্য ও কারসাজিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ সরকারি সংস্থাটিকে বাজার মূল্যের চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণ বেশি দামে কাগজ কিনতে বাধ্য হতে হয়। এভাবে এ অধিদপ্তরের সব ধরনের কেনাকাটায় প্রতিবছর সরকারকে লোকসান গুণতে হচ্ছে ৫০ কোটি টাকারও বেশি।

অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শুধু কাগজ কেনার ক্ষেত্রে টেন্ডারবাজি না থাকলে অর্থাৎ সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাগজ কেনা গেলে মোট লোকসানের ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ সাশ্রয় করা সম্ভব হতো।

সিন্ডিকেটের দখলদারিত্ব:
মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, তাদের অধীন বিজি প্রেস, গভর্নমেন্ট প্রিন্টিং প্রেস ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস- এই তিনটি প্রেসেই সরকারি সব রকমের ছাপার কাজ হয়। আর এ কাজের জন্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন স্টেশনারি অফিস বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকার কাগজ কেনাকাটা করে থাকে। সাধারণ ছাপার কাজ করার জন্য কর্ণফুলী পেপার ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে শৌখিন ছাপার ক্ষেত্রে বিদেশি অফসেট পেপার টেন্ডারের মাধ্যমে কেনা হয়। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের রঙিন পোস্টার, বার্ষিক ক্যালেন্ডার, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও অর্থ মন্ত্রণালয়েরবিভিন্ন প্রকাশনার কাচে চার রঙের কাজ করার জন্য বিদেশি অফসেট পেপার ব্যবহার করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, এসব কাগজ সরবরাহ নিয়ে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের আওতাধীন স্টেশনারি অফিস ঘিরে বছরের পর বছর চলে আসছে টেন্ডার সন্ত্রাস। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই টেন্ডার সন্ত্রাসের নিয়ন্ত্রক হলেন যুবলীগ নেতা ওবায়েদ উল্লাহ সিদ্দিকী কাজল। তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার নাম ভাঙিয়ে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছেন। কোন ঠিকাদার কোন রেটে, কী পরিমাণ কাগজ সরবরাহ করবেন তা নির্ধারণ করে দেন এই কাজল। এমনকি কে কে টেন্ডারে অংশ নিতে পারবে তাও নির্ভর করে কাজলের মর্জির ওপর।

আকবর আলী নামে স্টেশনারি অফিসের সাবেক একজন ঠিকাদার বাংলানিউজকে বলেন, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের টেন্ডার এখন যুবলীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে। যুবলীগ নেতা কাজলের সন্ত্রাসীদের ভয়ে টেন্ডারে অংশ নেওয়া তো দূরের কথা, অধিদপ্তরের আশপাশ দিয়ে হাঁটাও বিপজ্জনক বলে মনে করেন অন্যান্যরা।

এ কারণে অনেকেই ওই অধিদপ্তরে ঠিকাদারি ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে বলেও জানান তিনি।

জানতে চাইলে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে যুবলীগ ঢাকা মহানগর কমিটির সদস্য ওবায়েদ উল্লাহ সিদ্দিকী কাজল বলেন, আমি কোনো টেন্ডার সন্ত্রাস কিংবা টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করি না। আমি নিজেই ওই অধিদপ্তরের একজন তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। আমার প্রতিষ্ঠানের নাম মুন্নি এন্টারপ্রাইজ। আমার বাড়ি মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার নির্বাচনী এলাকায়। আর ঢাকায় আমি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এলাকায় বসবাস করি। এ কারণেই হয়তো আমার বিরুদ্ধে তাদের নাম ভাঙানোর মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, কাজল যুবলীগ করে। সে যদি আমার নাম ভাঙায় তাহলে অবশ্যই তদন্তপূর্বক তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের টেন্ডারবাজদের বিরুদ্ধে অচিরেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম মানজারুল হক বলেন, কাগজ কেনাকাটার ক্ষেত্রে যে সিন্ডিকেট গড়ে ওঠার অভিযোগ উঠেছে তা আমার জানা নেই। এ বিষয়টি স্টেশনারি অফিস ভালো বলতে পারবে।

স্টেশনারি অফিসের সাধারণ কর্মচারীরা জানান, তারা সন্ত্রাসীদের কাছে অসহায়। প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী টেন্ডারবাজদের হাতে নাজেহাল হয়েছেন। তাই ভয়ে তাদের কেউ ঘাঁটাতে চায় না।

টেন্ডারবাজি টিকিয়ে রাখতে বিদেশি কাগজ:
অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবছর সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কাজে যে পরিমাণ অফসেট কাগজ প্রয়োজন হয় তার পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। অথচ দেশে বর্তমানে অনেক উন্নতমানের অফসেট কাগজ তৈরি হচ্ছে, যার গুণগত মানও বিদেশি কাগজের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এমনকি বিদেশে রপ্তানিও হচ্ছে। দেশে তৈরি অফসেট কাগজ কেনা হলে যেমন কাগজ কেনার ক্ষেত্রে ব্যয় অর্ধেক কমে যাবে, অন্যদিকে দেশীয় কাগজশিল্প পৃষ্ঠপোষকতা পাবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৮০ গ্রামের বিদেশি অফসেট কাগজ প্রতি রিম কেনা হয় তিন হাজার থেকে তিন হাজার ১০০ টাকায়, যা খুচরা বাজারে দুই হাজার থেকে দুই হাজার ১০০ টাকায় কেনা সম্ভব। নয়াবাজারে কাগজের পাইকারি বাজারে গিয়ে একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া গেছে।

কর্ণফুলী পেপার মিলের কাগজের সরকারি মূল্য জানার জন্য স্টেশনারি অফিসের উপপরিচালক মীর মো. নজরুল ইসলামের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি নানা অজুহাতে এড়িয়ে যান। তবে ওই অফিসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিবছর কর্ণফুলী থেকে যে ৩০ কোটি টাকার কাগজ কেনা হয় তা খোলাবাজার থেকে কিনলে সর্বোচ্চ মূল্য ২০ কোটি টাকার বেশি হবে না।

মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে প্রতিবছর বিদেশি অফসেট কাগজ প্রায় ২০ কোটি এবং কর্ণফুলী পেপার মিলস থেকে প্রায় ৩০ কোটি টাকার সাধারণ কাগজ কেনা হয়। চাহিদার হেরফেরে এর পরিমাণ কিছু কমবেশি হয়ে থাকে।

অধিদপ্তরে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, কাগজের গুণগত মানের জন্য নয়, মূলত টেন্ডারবাজি টিকিয়ে রাখার জন্যই বিদেশি অফসেট কাগজ কেনা হচ্ছে। দেশে তৈরি অফসেট কাগজ কেনা হলে দরের ক্ষেত্রে কোনো রকম নয়-ছয় করা যাবে না। কারণ দেশি কাগজের মূল্য নির্ধারণ করা থাকে। স্টেশনারি অফিসের ফাইল তলব করলে দেখা যাবে, দেড় থেকে দ্বিগুণ দামে বিদেশি কাগজ কেনা হয়। টেন্ডারে কোনো প্রতিযোগিতা থাকে না বলে যোজসাজশের মাধ্যমে মূল্য ঠিক করে সরকারের কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা হয়।

স্টেশনারি অফিসের দাবি, কাগজের টেন্ডার সম্পন্ন করার আগে বহুল প্রচারিত দুটি বাংলা এবং একটি ইংরেজি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, যাতে সবাই টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, যেসব পত্রিকায় টেন্ডার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, সেগুলোর বেশির ভাগই ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ কিংবা কম প্রচারিত দৈনিক। নিয়ম রক্ষার স্বার্থে অনেক সময় পত্রিকার কয়েকটি কপিতে টেন্ডার বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে পরে সেখান থেকে তা তুলে ফেলা হয়, যাতে বিজ্ঞাপনটি বেশি মানুষের চোখে না পড়ে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, অতি সম্প্রতি বিদেশি অফসেট কাগজ কেনার জন্য যে তিনটি পত্রিকায় টেন্ডার নোটিশ ছাপানো হয়েছে তা কারো চোখে পড়েনি। এর মধ্যে নোটিশ ছাপানো ইংরেজি পত্রিকাটির শুধু ‘অফিসিয়াল কপিই’ ছাপা হয়। এসব পত্রিকা বাজারে পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশে উন্নতমানের কাগজ উৎপাদনকারীদের মধ্যে রয়েছে পারটেক্স গ্রুপ, টিকে পেপার মিলস, কনিক পেপার মিলস লিমিটেড, বসুন্ধরা পেপার মিলস লিমিটেড, ম্যাফ নিউজ প্রিন্ট লিমিটেড ইত্যাদি।

পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও হাসেম পেপার মিলের মালিক আবুল হাসেম বলেন, ‘বাংলাদেশি কাগজ বিশ্বমানের, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এ অবস্থায় বিদেশ থেকে কাগজ আমদানির প্রয়োজন নেই।’

অভিযোগ সম্পর্কে স্টেশনারি অফিসের উপপরিচালক মীর মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করব না। আপনারা সরেজমিনে এসে পরিস্থিতি দেখে যান। তদন্ত করলেই প্রকৃত ঘটনা জেনে যাবেন।’

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম মানজুরুল হক বলেন, ‘আমি মহাপরিচালক হলেও ক্রয়কৃত কাগজ চোখেও দেখি না। তা নিয়ন্ত্রণ হয় অধিদপ্তরের অধীনস্থ স্টেশনারি অফিস থেকে। তারাই কাগজের টেন্ডার নিয়ে ভালো বলতে পারবেন। আমরা শুধু ফাইল সই করি।’

নিকৃষ্টতম কাগজ:
দেশে এত উন্নতমানের কাগজ থাকতে অত্যন্ত নিকৃষ্টমানের কাগজে ছাপা হচ্ছে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দলিল-দস্তাবেজ, নথিপত্র, গেজেট, জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণীসহ আরো অনেক ফরম ও প্রকাশনা। সরকারি অনেক ছাপার কাজ আছে, যা শত শত বছর সংরক্ষণ হয়ে থাকে। নিম্নমানের কাগজ দিয়ে সেসব ছাপার কাজ করা হয় বলে কয়েক বছরের মধ্যে তা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষ।

জানা যায়, কর্ণফুলী পেপার মিলসে উৎপাদিত অত্যন্ত নিম্নমানের কাগজ দিয়ে করা হচ্ছে বালাম বই। অভিযোগ আছে, এতে লিখতে গেলে কালি ছড়িয়ে যায়। এক পৃষ্ঠার কালি অন্য পৃষ্ঠায় দেখা যায়, যার জন্য ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রারের অফিস থেকে লিখিতভাবে নিম্নমানের কাগজ সম্পর্কে অভিযোগ করা হয়েছে।

জাতীয় সংসদে আইন হিসেবে পাস হওয়া গেজেট কিংবা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পরিপত্র রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসেবে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু নিম্নমানের কাগজে ছাপা বলে তা কিছুদিনের মধ্যেই ছিঁড়ে যায়। এ কথা বাংলাদেশ ফরম ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে স্বীকার করে বলা হয়, নীতিমালা পরিবর্তন ছাড়া সরকারি প্রকাশনার গুণগত মানে কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের একজন পরিচালক বলেন, কর্ণফুলী পেপার মিলস থেকে কাগজ না নিয়ে বেসরকারি কোনো মিল থেকে কিনলে সরকার প্রতিবছর ২০-২৫ কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারবে। কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অধিদপ্তর প্রায় দ্বিগুণ দামে কাগজ কিনতে বাধ্য হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, সরকারি কাগজ ও আনুষঙ্গিক পণ্যসামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে প্রচলিত নীতিমালা পরিবর্তন করা না হলে এ অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে না। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম