স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংক গভীর অসুখে আক্রান্ত, তখন অনেকটা গডম্যানের ভূমিকায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপত্র না মেনে উপায় নেই। অর্থমন্ত্রী ব্যাংকিং ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী আছে, এ কথা প্রকাশ্যে বললেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ এরই মধ্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সাবধান করে দিয়ে বলেছে, ঋণ আদায় ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় আরো উন্নতি আনতে হবে। আর সাময়িক স্বাধীনতা হারালেও আইএমএফের ব্যবস্থাপত্র মেনে একগুচ্ছ প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে নতুন করে সমঝোতা চুক্তি স্বার করতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক নতুনভাবে তিন মাসের জন্য সমঝোতা স্মারকে স্বার করেছে।
নতুন সমঝোতা অনুযায়ী, চার ব্যাংককে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নিজস্ব ঋণ নীতিমালা ও ঋণ ঝুঁকি মোকাবেলার নীতিমালা প্রস্তুত করতে হবে। পাশাপাশি বেঁধে দেয়া হয়েছে ঋণ প্রবৃদ্ধিও।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এসব ব্যাংককে কোম্পানি করা হয়েছিল ভালো উদ্দেশ্যে। কিন্তু তা সফল হয়নি। জনগণের আমানত থাকা প্রতিষ্ঠান যদি লুটপাট করে, তাহলে তো হবে না। দাতা সংস্থগুলোর শর্ত মেনে নিয়েও যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর তদারক করে, তাও ভালো। তাদের শর্ত মেনে ভালোভাবে চালালে তা দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক।
তবে আইএমএফের প্রস্তাবিত ব্যবস্থাপনাকে সতর্কতার সঙ্গেই দেখছেন সোনালী ব্যাংকের পরিচালক ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আইএমএফ অন্য দেশের ব্যাংকিং খাতের বিধিব্যবস্থা বাংলাদেশে হুবহু চালুর চেষ্টা করে। এেেত্র এ দেশের পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করা হয় না। ফলে শর্ত বাস্তবায়ন করার পরও কাঙ্তি ফল পাওয়া যায় না। ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে প্রয়োজন সুষম শর্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জুনভিত্তিক হিসাবে, রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের মোট মূলধন ঘাটতি ৯ হাজার ৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সোনালী ৪ হাজার ৫৪৪ কোটি, জনতা ১ হাজার ৬২৩ কোটি, অগ্রণী ২ হাজার ৪৮১ কোটি ও রূপালী ব্যাংকের ৪১৪ কোটি টাকা। এছাড়া খেলাপি ঋণও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। চলতি বছরের জুন শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা, যা ওই ব্যাংকের মোট ঋণের ৩৮ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। জনতা ব্যাংকে ৪ হাজার ২১৪ কোটি টাকা, যা ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকে ৪ হাজার ৬০৬ কোটি, যা ২২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকে ২ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা, যা ২৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
আইএমএফের শর্তানুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১২-এর ডিসেম্বর ভিত্তিতে চার ব্যাংকের ডায়াগনস্টিক প্রতিবেদনও তৈরি করে। প্রতিবেদনে সোনালী ও জনতা ব্যাংকের পরিস্থিতিকে অ্যালার্মিং বা উদ্বেগজনক এবং অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের পরিস্থিতিকে কনসিডারেবল বা বিবেচনাযোগ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আর ক্যামেলস রেটিংয়ে সোনালী ব্যাংকের অবস্থা অসন্তোষজনক এবং বাকি তিন ব্যাংকের অবস্থা প্রান্তিক পর্যায়ে নেমে এসেছে।
শুধু আইএমএফ নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংকও। সংস্থাটি মনে করে, সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক দেশে-বিদেশে আস্থার সংকটে পড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এসব ব্যাংক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের েেত্র প্রতিবন্ধকতার সম্মুখিন হতে পারে। এমনকি বিদেশী ব্যাংকগুলো এসব ব্যাংকের ঋণপত্র গ্রহণে আপত্তি জানাতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি তদারকিতে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছে। এরই অংশ হিসেবে মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক অবসায়নের এ কর্মপরিকল্পনার নাম দেয়া হয়েছে কন্টিনজেন্সি প্ল্যানিং।
সূত্র জানিয়েছে, মূলধন পর্যাপ্ততা, সম্পদের গুণগত মান, তারল্য, উপার্জনমতা, ব্যবস্থাপনা দতায় পিছিয়ে থাকা সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক অবসায়নের কর্মপরিকল্পনাও অনুমোদন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈঠকে। কর্মপরিকল্পনাটির আলোকে মূলধন ঘাটতিসহ বিভিন্ন সমস্যা ব্যাংকিং সিস্টেমে না রেখে সেগুলো অবসায়ন করতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বড় কোনো ব্যাংক বিলুপ্তির কারণে পুরো ব্যাংকিং সিস্টেম তিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে ওই ব্যাংক অবসায়ন করা হবে না। এেেত্র সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিশেষ শর্ত পরিপালনের ল্যমাত্রা দেয়া হবে।
যেমন— ব্যাসেল-২ নীতিমালায় ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ১০ শতাংশ মূলধন সংরণ করতে হয়। কিন্তু ত্রে বিশেষে ১০ শতাংশের পরিবর্তে ১১ শতাংশ মূলধন সংরণের শর্তও দেয়া হতে পারে।
রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর চলমান সমস্যা কাটিয়ে ওঠা প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ফিনেক্সেলের চেয়ারম্যান আবু নাসের বখতিয়ার বলেন, ব্যাংকগুলোর নিজ নিজ দতায় প্রধান সূচকগুলো ভালো রাখতে হবে। সরকার বা অন্য কেউ ভালো করে দিতে পারবে না। সরকার যদি মূলধন জোগান না দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঋণ শোধ করে দেয়, তাহলেই ভালো হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। তা নিশ্চিত করতে হবে, তারও বিকল্প নেই।