জেলা প্রতিনিধি, কক্সবাজার ॥ কোরবানী ঈদ ও পূজাকে সামনে রেখে মিয়ানমারে পন্য পাচার শুরু করছে চোরকারবারীরা। আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের দূর্গা পূজা উৎসব উপলক্ষ্যে উখিয়া টেকনাফ সীমান্ত থেকে হাজার কোটি টাকার পন্য চোরাচালান বানিজ্যের কর্মসূচী বাস্তবায়নে চোরাচালানী চক্র তৎপর হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে চোরাকারবারীরা পাচার কাজে মাঠে নেমে পড়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।
আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ একাধিক সূত্রে জানা যায়, ৯০ শতকের পর থেকেই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের কিছুলোকের পৃষ্ঠপোষকতায় চলে আসছে এ চোরাচালানী কার্যক্রম। মূলত সে কারনেই আইন শৃংখলা বাহিনী যথাযথ ভাবে চোরাচালান প্রতিরোধ করতে পারছে না।
চলমান চোরাচালানী কার্যক্রমের পিছনেও আছে শক্তিশালী রাজনৈতিক গডফাদারের ছত্রচ্ছায়া। হাজার কোটি টাকার চোরাই বানিজ্যের আওতায় দেশীয় চোরাচালানের তালিকায় রয়েছে সুখী ট্যাবলেট, ইনজেকশন বিভিন্ন ধরণের ঔষধ, তেল, সার, মাছ, নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, কাচাঁ তরকারী, শুকনো খাবার, হেরোইন, ফেন্সিডিল, গাঁজা, সেমাই, মসলা, থান কাপড়, কসমেটিকস আইটেম ইত্যাদি। প্রাপ্ত তথ্যে আরো জানা গেছে, চোরাচালানের তালিকায় সুবিধা মত গম, চিনি, গুড়, পিয়াজ, রশুন আদার মত নিত্যপন্যও প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হচ্ছে।
পাশাপাশি মরণনেশা ইয়াবা ট্যাবলেট, সুপারী, ক্যালসিয়াম, আচার, লুঙ্গি, গামছা, তিল, সুপারী, চুলসহ কোটি কোটি টাকা মূল্যের মালামাল মিয়ানমার থেকে আসছে। অন্যদিকে চোরাই পণ্যের বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে উন্নতমানের ইউরিয়া ও টিএসপি সার, কাঁসা-পিতলের মতো মূল্যবান ধাতবদ্রব্য পাচার হচ্ছে মিয়ানমারে।
অতি সম্প্রতি মিয়ানমারে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় বিনিময় মূল্য ছাড়াও ডলার পাচার করা হচ্ছে। সংগত কারনেই এর ফলে দেশের অর্থনীতি চরম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ব্যাপকভাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যাবসায়ী জানান, বিশেষ করে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তবর্তী ডেইলপাড়া, দরগা বিল, আনজিমানপাড়া, রহমতের বিল, বালুখালী পানবাজার, থাইনখালী, পালংখালী, তুলাতলী, আমতলী, শাহপরীরদ্বীপ, নয়াপাড়া, সাবরাং, নাজিরপাড়া, চকবাজার, হাঙ্গার ডেইল, জালিয়াপাড়া, লামার বাজার, নাইট্যং পাড়া কেরুনতলী, বরইতলী, দমদমিয়া, জাদিমুরা, মোচনী, লেদা, আলীখালী, রঙ্গিখালী, নাটমোরা পাড়া, হ্নীলা, মৌলভীবাজার, খারাংখালী, নয়াবাজার, মিনাবাজার, নয়াপাড়া, উনছিপ্রাং, হোয়াইক্যং এলাকায় দিয়ে নৌ-পথে এসব পন্য পাচার হয়।
উল্লেখ্য, ডেইল পাড়া, বালুখালী, রহমতের বিল, আনজিমান পাড়া, নয়াপাড়া, কায়ুকখালী খাল, জাদিমুরা দিয়ে সবচেয়ে বেশি মালামাল যা মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যেই সীমান্তের নাফ নদীর তীর থেকে মিয়ানমারে পৌছানো যায়। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে উখিয়া টেকনাফ সীমান্তে গড়ে উঠেছে ৫০/৬০ টি চোরাচালান সিন্ডিকেট। এ রকম বহুবিধ সুবিধার কারণে আসন্ন ঈদুল আযহার বাজার পুরোপুরি দখলে রাখতে দেদারসে সীমান্ত পথে পাচার হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা মূল্যের রকমারী দেশীয় পন্য।
উখিয়া টেকনাফের ব্যবসায়ীরা সীমান্তের চোরাচালান সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের বাছাই করা পন্য সামগ্রী মোবাইলে অর্ডার পাওয়া মাত্রই মিয়ানমারে পাঠাচ্ছে। বিনিময়ে চোরাচালান সিন্ডিকেট কমিশনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা মুল্যের মাদকের চালান এদেশে পাটাচ্ছে।
ফলে মিয়ানমারের পন্য কিনে বেশী লাভ ও ক্ষতির ভয় না থাকায় বাংলাদেশী বড় বড় ব্যবসায়ীরা মিয়ানমারের মাদকসহ বিভিন্ন পন্য কেনার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এতে প্রতিদিন উখিয়া টেকনাফ সীমান্ত পথে কোটি কোটি টাকার মাদকসহ উন্নতমানের কাপড় বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করছে।
এছাড়াও উখিয়া টেকনাফ সীমান্ত পথে মিয়ানমারে ঈদের জন্য প্রয়োজনীয় ময়দা, সুজি, ছোলা, বুট, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচী, জিরা, মরিচ, গুড়া মসলা, আতর, সেণ্ট, সেভিং ক্রীম, সেভিং লোশন, বডি লোশন, রেডিও টেলিভিশনের যন্ত্রাংশ, সাইকেল, মটর সাইকেল ও তার যন্ত্রাংশ, বাস ট্রাকের ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ, ঘর ওয়ারিং সহ বৈদ্যুতিক ও সেনেটারী সামগ্রী, সপিং ও পলিথিন ব্যাগ, ফেনসিডিল সহ নানা প্রকার মাদক দ্রব্য পাচার হচ্ছে।
প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে শুরু করে সারারাত উল্লেখিত সীমান্ত দিয়ে এসব পন্য মিয়ানমারে ও বাংলাদেশে আনা নেওয়ার কাজ চলে। মিয়ানমারের লুন্ঠিন বাহিনী সাপ্তাহিক চুক্তিতে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তারকাটার বেড়ার গেট খুলে এবং নাফ নদী সীমান্তে নৌকাযোগে এসব পন্য আনা নেয়ার কাজে সহায়তা করছে।
বিজিবি‘র ৪২ ব্যাটালিয়নের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর শফিকুর রহমান বলেন, সীমান্তের গ্রামবাসীদের অনেকেই চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত থাকায় বিজিবির পাহারা থাকার পরও অনেকক্ষেত্রে চোরাচালানি পণ্য আটক সম্ভব হয় না। তবুও প্রায় প্রতিদিনই অভিযান পরিচালনা করে ইয়াবা, ক্যারেন্টজাল, মদ ও কাপড় সামগ্রী আটক করছে বিজিবি সদস্যারা।
এদিকে উখিয়া টেকনাফ স্থল বন্দর দিয়ে পন্য সামগ্রী না এনে চোরাচালানী চত্রু পাশ্ববর্তী সীমান্ত পয়েন্টগুলো দিয়ে অবৈধ পথে অবাধে পন্য নিয়ে আসার ফলে টেকনাফ স্থল বন্দরের রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে বিরাট ধরণের ধস নেমেছে। অভিঞ্জ মহলের মতে সীমান্তের চোরাচালান প্রতিরোধে এগিয়ে না আসলে অদূর ভবিষ্যতে টেকনাফ স্থল বন্দরের আমদানী রপ্তানীর উপর বিরুপ প্রভাব পড়বে।