বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: বিএনপির হরতাল-অবরোধ তার স্বরূপে চলছে না এটা ঠিক। কিন্তু এর প্রভাব অস্বীকার করতে পারছে না স্বয়ং সরকারও। তবে দীর্ঘদিন ধরে চলা এ সংকট সমাধানের কোনো লক্ষণও সরকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা ‘এক সপ্তাহে সব ঠিক হয়ে যাবে’ বলে আশ্বাস দিলেও কেটে গেছে কত ‘এক সপ্তাহ’। ফলে সরকারের আশ্বাসে আর মানুষের মন ভরে না।
সরকার না পারলেও কূটনীতিক থেকে নাগরিক সমাজ্- সংকট সমাধানে তাদের উদ্যোগে আবার সরকারের মন ভরে না। টিভি চ্যানেল কিংবা সংবাদপত্র, সেখানে টানাপোড়েন।
ফলে বোঝা যাচ্ছে, সরকার একলা চলো নীতি নিয়েছে কিংবা একলা হয়ে যাচ্ছে। এমনকি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগুলোও সরে যচ্ছে দূরে।
কূটনীতিক
বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা সরকারের সঙ্গে আছে, এমন একটা ধারণা ছড়ানো ছিল। কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার দক্ষ লোকও রয়েছে আওয়ামী লীগে। তারা ভালোভাবে কাজটি করছিলেন বলেই মনে করা হতো। কিন্তু গত কদিনের ঘটনা এ ক্ষেত্রে ভিন্ন ধারণা ফুটিয়ে তুলেছে।
জাতিসংঘ, ক্রাইসিস গ্রুপ, হিউম্যান রাইটসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার বিবৃতি সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। মঙ্গলবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের নেতৃত্বে প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে যাওয়ার বিষয়টি সরকারের জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে। বার্নিকাট যেভাবে প্রভাবশালী কূটনীতিকদের সংঘবদ্ধ করে গুলশান কার্যালয়ে হাজির হলেন, তা সরকারও ভাবতে পারেনি।
কূটনীতিকরা পৌনে দুই ঘণ্টা খালেদার সঙ্গে কথা বলেন। খালেদাও তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করেছেন। সরকার যে তাকে নো-রিটার্ন পর্যায়ে ঢেলে দিয়েছে, সেটি কূটনীতিকদের স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন খালেদা। জানিয়েছেন ৫৭ দিনে ২০-দলীয় জোটের ১১৪ জনকে ক্রসফায়ায়ে দেয়ার ঘটনা। বলেছেন তার দলের কেন্দ্রীয় অফিস তিন মাস ধরে বন্ধের কথা। জানিয়েছেন তিনি সংলাপের পক্ষে।
এত দীর্ঘ সময় ধরে কারও সঙ্গে কূটনীতিকদের বৈঠক সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্ করা যায়নি।
কূটনীতিক মহলের খোঁজ-খবর রাখেন এমন একজন সিনিয়র সাংবাদিক জানালেন, প্রভাবশালী দেশের দূতাবাসগুলো সম্ভবত সংকটের সমাধান চাচ্ছেন। এ কারণে তারা আটঘাট বেঁধে সক্রিয় হয়েছেন। তাদের সক্রিয়তা সরকারের জন্য স্বস্তিকর নয় বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব জয়শঙ্করের সফরও সরকারের জন্য ইতিবাচক কোনো বার্তা নিয়ে আসেনি। তবে জয়শঙ্কর নেতিবাচক কোনো বার্তাও দেননি। তার সফরে সরকার আশাবাদী হতে পারেনি। এ কারণে এই বিষয়টি নিয়ে সরকারের কেউ ভালো-মন্দ কিছুই বলেনি। চুপ থাকাটাকেই শ্রেয় মনে করেছেন।
জাতীয় সংলাপ কমিটি
এই কমিটির সবাই যে আওয়ামী লীগের সমর্থক তা কারো অজানা নয়। ১/১১-এর ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততার কথা সবাই জানে। ওই সময় এদের আগমনে আওয়ামী লীগ বলেছিল, মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার তাদের আন্দোলনের ফসল। কিন্তু আজ আওয়াম লীগ তাদের এই মিত্রদের তুলাধোনা করছে। দলের নেতা-মন্ত্রীরাও যা-তা বলে যাচ্ছেন।
মান্না প্রসঙ্গ
মাহমুদুর রহমান মান্না একসময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। সংস্কারের পক্ষে থাকার দায়ে তিনি পদ হারান। দলে ব্রাত্য হয়ে যান। এরপর টিভি টক শোতে কথা বলে তিনি তার আলাদা একটা ইমেজ গড়ে তোলেন। সাধারণ মানুষ তার কথা শুনত এবং পছন্দও করত। তিনি নাগরিক ঐক্য নামে একটি সংগঠনও গড়ে তোলেন। তার সঙ্গে আছেন ড. কামাল হোসেন, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, আসিফ নজরুলের মতো ব্যক্তিরা। মান্না বিএনপির সঙ্গে যে একটি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছিলেন তা কারো অজানা নয়। বলতে গেলে, তিনি বেশ লাইম লাইটেই চলে এসেছিলেন।
সরকার মান্নার তৎপরতাকে শুরু থেকেই ভালো চোখে দেখেনি। মন্ত্রী ও দলের নেতারা প্রায়ই মান্নার বিরুদ্ধে বিষোদগার করতেন। সরকারে বিরুদ্ধে তৎপরতার অভিযোগ এনে তাকে ধরা হলো। এখন তিনি আছেন রিমান্ডে।
দেশের প্রধান দল বিএনপি থেকে অনেকেরই দৃষ্টি মান্নার দিকে যাচ্ছে। আন্দোলনে বিএনপি নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা চলছিল। কিন্তু মান্না আটক হওয়ায় দেশের মানুষের দৃষ্টি আবার বিএনপির ওপর পড়েছে। আসলে এই সরকারকে যারা পছন্দ করেন না তাদের একমাত্র ভরসারস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছ খালেদা জিয়া। সরকারের প্রধান শত্রু খালেদাই এখন আলোচিত।
সরকার যতই খালেদাকে একগুঁয়ে বলে সমালোচনা করুকনা কেন, তার এই আপসহীতনাকেই বিরোধীপক্ষ সমর্থন করে যাচ্ছে। তারা বলছে, খালেদার আপোষহীনতার কারণেই এরশাদ ও মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনদের বিদায় নিতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারকেও নিতে হবে। সরকার তার নিজের কাজের মাধ্যমেই খালেদাকে আরো বেশি ফোকাসড করে ফেলেছে।
ডেইলি স্টার-মাহফুজ আনাম
দেশের বেশির ভাগ মিডিয়াই আওয়ামী লীগের পক্ষে। মালিকদের বেশির ভাগই এই দলটির সমর্থক। অন্যদিকে বিএনপির মিডিয়া নেই বললেই চলে। দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার দলকানা নয়। তারা তাদের নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে এগোয়। ১/১১ তার প্রমাণ। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহমুজ আনাম আওয়ামী লীগ ঘরানার লোক বলেই সবাই জানে। তাকেও সরকার নিজেদের লোক মনে করে না। ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর অফিসেও ডেইলি স্টারের সাংবাদিক নিষিদ্ধ।
সর্বশেষ, সম্পাদক পরিষদের বিবৃতি নিয়ে সরকারের মূখপাত্র বলে পরিচিত কয়েকটি মিডিয়া যেভাবে মাহফুজ আনামকে নাকানি-চুবানি খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে, তা হতবাক করার মতো। তারা সরকারের ইঙ্গিতেই এ কাজটি করেছে বলে দেশের মিডিয়া জগতে প্রচার আছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভরশীলতা
যতই তিন যাচ্ছে ততই আওয়ামী লীগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্তাব্যক্তি বিরোধীপক্ষকে দমনে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। এটি সরকারকে আরো জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার-বাণিজ্যের বিষয়টি এখন ওপনেসিক্রেট। এই বাণিজ্যের সহযোগী হিসেবে দলের নেতাকর্মীরাও নেমে পড়েছে। মফস্বলে দলের নেতাকর্মীদের এই ধরনের ভূমিকা সহজেই চোখে পড়ে। আর এতে সরকারের প্রতি জনরোষের মাত্রা কেবল বাড়ছেই।
সরকার সম্ভবত জুনিয়র বুশের নীতি অবলম্বন করেছে। হয় আমার দলে থাকবে, নতুবা তুমি বিরোধী পক্ষ। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মঞ্জুরুল আহসান খান এক টিভি টকশোতে বলেছেন, এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে ‘বিএনপির লোক’ বলা হয়। নতুন বার্তা ডটকম