টানা হরতালে বিপর্যস্ত স্কুল শিক্ষা কার্যক্রম

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: টানা অবরোধ হরতালে রাজধানী ঢাকায় প্রায় সব স্কুলেই স্থবির হয়ে পড়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। সপ্তাহের কর্ম-দিবসগুলোতে বন্ধ থাকছে স্কুল।

আর ক্লাস হচ্ছে ছুটির দিন শুক্র ও শনিবারে। এর ফলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক সবার মনেই তৈরি হয়েছে উদ্বেগ, আতঙ্ক আর হতাশা। অন্যদিকে সপ্তাহে টানা ৫টি দিন স্কুলে কোনধরনের পাঠদান তো চলছেই না, বন্ধ রয়েছে শিক্ষার্থীদের সামাজিক মানসিক বিকাশের অন্যান্য কার্যক্রমও।
এতে করে তাদের বর্তমান শিক্ষাজীবন পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের বিষয়েও আশংকার কথা বলা হচ্ছে।
বাড়িতে শিক্ষার্থীদের অলস সময়
ধানমন্ডী এলাকায় দুপুর বারোটার দিকে একটি বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় কম্পিউটারে গেমস খেলছে ঢাকার নামকরা একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র মুহতাসিম।
পাশেই পড়ার টেবিলে গুছিয়ে রাখা বইপত্রের পাশে ল্যাপটপ রেখে তাতে ইংরেজি ভাষায় সিনেমা দেখছে ছোট ভাই চতুর্থ শ্রেণীর এহতেশাম। অথচ এই সময় তাদের কথা ছিল স্কুলে থাকার।
কিন্তু এখন সপ্তাহের ৫ দিনই তাদের স্কুলে যেতে হয় না। ফলে হাতে তাদের অফুরন্ত অবসর। এমন চিত্র ঢাকার বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর বাড়িতেই।
ছুটির দিনে ছুটি নেই,
গত জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে অবরোধ শুরুর পর একাধিকবার পেছাতে হয়েছে মাধ্যমিক পরীক্ষা।
আর অবরোধের পাশাপাশি নিয়মিতভাবে সপ্তাহ জুড়ে হরতালের কর্মসূচি থাকায় স্কুলগুলো ছুটির দিনগুলোতে ক্লাস নেয়ার ঘোষণা দেয়।
এরপর থেকে প্রায় দুমাস ধরে ঢাকার সরকারি-বেসরকারি মোটামুটি সব স্কুলেই এখন এই ব্যবস্থা চলছে।
গত সোমবার সরকারি বেসরকারি একাধিক স্কুলে গিয়ে দেখা যায় কোনও শিক্ষার্থী নেই। শুধু শিক্ষক-কর্মকর্তারা রয়েছেন স্কুলে।
তবে মঙ্গলবার গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিজয়ে মঙ্গলবারের হরতাল শিথিল করায় স্কুলে সেদিন শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দেখা গেল।
অনেকদিন পর হঠাৎ করে একদিনের জন্য হরতাল শিথিলের ঘোষণায় শুক্র-শনিবার ছাড়াই স্কুলে আসতে পেরেছে উচ্ছ্বাসিত শিক্ষার্থীরা।
পড়াশোনায় বাড়তি চাপ
শুধু দুদিন ক্লাস নেয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। এই দুদিনে একসাথে অনেকগুলো পরীক্ষাও দিতে হচ্ছে।
কিন্তু মাত্র দুদিনের ক্লাসে নিজেদের সিলেবাস কিভাবে শেষ হবে, তা নিয়ে চিন্তা রয়েছে শিক্ষার্থীদের মনে।
বেশ কয়েকটি স্কুলের সপ্তম, অষ্টম, নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপকালে তারা জানায়, “ সারাদিন ঘরে থেকে থেকে একঘেয়ে হয়ে গেছে দিন-রাত। আর স্কুলে দুদিনের ক্লাসে শিক্ষকরা দ্রুত সিলেবাস শেষ করার জন্য অতিরিক্ত চাপের সাথে তাল মেলানো কঠিন হয়ে পড়েছে”।
অসহায় অভিভাবকেরা
ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা এবং বর্তমানে সময়ে তাদের যেভাবে সময় কাটাতে হচ্ছে তা নিয়ে বাবা-মায়েদের দুশ্চিন্তা আরও বেশি।
অনেক অভিভাবক বলছেন, বাইরে খেলতে যাওয়ারও সুযোগ বা স্বাভাবিক পরিবেশ নেই । ফলে ৫টি দিনই ঘর-বন্দী থাকতে হচ্ছে ছেলেমেয়েদের।
এমনই একজন অভিভাবক রেজাউল হক শাহীন বলছিলেন, “বাচ্চারা বাড়িতে সারাক্ষণ থাকলেও আগের মতো পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারছে না।
স্কুলের নিয়মতান্ত্রিক এবং নিয়মিত পাঠদানের বদলে একগাদা হোম-ওয়ার্ক দিয়ে তো শিক্ষা হয় না। বাসায় সারাক্ষণ গেমস, কম্পিউটার এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকছে।
এটা শুধু শিক্ষার্থীদের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলেছে তা নয়। বাবা-মায়েদের ওপরও প্রভাব ফেলেছে”।
এতদিন সন্তানদের লেখাপড়ার সাথে তাল মিলিয়ে বাবা-মায়েরা নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের রুটিন সাজিয়ে নিয়েছিলেন।
সেখানে এখন পাল্টে ফেলতে হচ্ছে বাবা-মায়েদের রুটিনও। বিষয়টি বাড়তি উদ্বেগ তৈরি করেছে কর্মজীবী বাবা-মায়েদের মাঝে।
পেশায় ফিজিওথেরাপিস্ট নাসরিন নাসির জানান, নামকরা একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে তার সন্তান পড়ছে।
পাঁচদিনের কাজের জন্য বাচ্চাদের সময় দিতে পারেন না।
আবার ছুটির দুদিন বাচ্চারা থাকে স্কুলে। ফলে বাচ্চাদের সাথে দেখা সাক্ষাতের সুযোগও কমে যাচ্ছে।
“বিদ্যালয়ে শুধু শিক্ষাই ব্যাহত হচ্ছে না, ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মানসিক-সামাজিক বিকাশও।”
শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন গণস্বাক্ষরতা অভিযান ক্যাম্পের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী।
তিনি বলেন, বিষয়টি কোমল-মতি শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন এবং মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
তিনি বলেন, “বিদ্যালয় তো শুধুমাত্র শিক্ষাই দেয় না। বিদ্যালয় একজন শিক্ষার্থীদের পূর্ণ বিকাশের জায়গা।
সেখানে সব শিক্ষার্থীর একত্রে বেড়ে ওঠা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষকদের সংস্পর্শ সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে বিকশিত হয় শিক্ষার্থীদের জীবন।
এভাবে বিকল্প পন্থায় পাঠদানে ছাত্র-ছাত্রীদের সামাজিক মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।
তার ওপর কম্পিউটার, টেলিভিশন ইত্যাদির ওপর ছাত্র-ছাত্রীদের আসক্তিও খারাপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন রাশেদা কে চৌধুরী।
তবে ঢাকার বেশ কয়েকটি নামকরা বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা জানালেন, বাবা-মায়েরাও বর্তমান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার কারণে অন্য দিনগুলোতে ক্লাস নেয়ার বিপক্ষে।
যারা দূরে থাকেন তারাও আসতে চান না। ফলে দুদিন ক্লাস নেয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। কিন্তু দুদিনের পাঠদানে কতটা পুষিয়ে দেয়া সম্ভব বলে মনে করেন শিক্ষকরা?
ইউভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ মো হাবিবুর রহমান বলছিলেন, দুমাস ধরে তারা দুদিন ক্লাস নিচ্ছেন এবং শিক্ষকদের অতিরিক্ত বাড়ির কাজ দিতে বলা হয়েছে।
কিন্তু এতে করে স্বাভাবিক সময়ের মতো পাঠদান সম্ভব হচ্ছে না বলে তিনি নিজেও স্বীকার করেন।
শিক্ষকদের অবশ্য সাতদিনই স্কুলে আসতে হচ্ছে। অধ্যক্ষ মি. রহমান জানান, এরকম অবস্থার পরিবর্তন না হলে গ্রীষ্মের ছুটিতেও ক্লাস নিতে হবে ।
শিক্ষার্থীদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের আশঙ্কা
এই অবস্থার ফলাফল শুধু সাময়িক নয় বলে মনে করেন রাশেদা কে চৌধুরী । তিনি বলেন, সাধারণত যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে এমন সঙ্কট দেখা যায়।
আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা এখন সে ধরনের অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। এটা জাতির জন্য একটি অশনি সংকেত।
পুরো শিক্ষা ক্যালেন্ডারে এর প্রভাব ফেলছে যা দীর্ঘমেয়াদী সেশন জটের কারণ হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে এই অস্থিরতার ফলে মেয়েদের বাল্যবিবাহ বেড়ে যেতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।
তবে সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর ক্ষেত্রে নিরাপত্তার প্রশ্নটি জড়িত থাকায় দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না অনেক অভিভাবক।
ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনেক বাবা-মাকে বাড়তি টাকা খরচ করে নতুন করে টিউটর কিংবা কোচিং এর ওপর ভরসা করতে হচ্ছে।
সব মিলিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি বিপর্যয় নেমে এসেছে বলে মনে করছেন শিক্ষক এবং অভিভাবকরা। এ বিপর্যয় কবে কাটবে সেটাই তাদের প্রশ্ন। বেঙ্গলিনিউজটোয়েন্টিফোর.কম ডেস্ক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫