বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা : বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের হরতাল-অবরোধে ট্রেন চলাচল স্বভাবিক হলেও সিডিউল শতকরা ৬০ ভাগ উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। তবে যাত্রীদের আতঙ্ক এখনো কাটেনি।
গত ৫ জানুয়ারির পর থেকে হরতাল-অবরোধের ৫৬দিনে ১০৩টি নাশকতার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলে ২৯টি এবং পূর্বাঞ্চলে ৭৪টি নাশকতার পর সারাদেশের ট্রেনের সিডিউল ভেঙে পড়ে।
হরতাল অবরোধের সময় দুর্বৃত্তরা বিশেষ করে রেল লাইন উপড়ে ফেলা, ফিশপ্লেট খুলে ফেলা, লাইনে আগুন দেয়া, স্পিপার তুলে ফেলার কারণে রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এ সময় কোন ট্রেনেরই সিডিউল ঠিক থাকেনি। তুলে ফেলা রেললাইন ঠিক না করা পর্যন্ত তা স্বাভাবিক হয়নি। তবে ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়ের পেছনে রেল কর্মীরাও কম দায়ী নয় বলে মনে অনেকে মনে করছেন।
ট্রেনে নাশকতা রোধে রেল কর্তৃপক্ষ সারাদেশে ১ হাজার ১৪২টি ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে ৮ হাজার ৩২৮ জন আনসার নিয়োগ করেছে। পাশাপাশি জিআরপি, আরএনবি যৌথভাবে টহল জোরদার করা হয়। এর পর থেকে ট্রেনের সিডিউল ঠিক হতে থাকে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো: আমজাত হোসেন জানান, শকতরা ৬০ ভাগ ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। গত ৫৬ দিনে ৩ কোটি ২১ লাখ ১৫ হাজার টাকা সম্পদ নষ্ট করেছে দুর্বৃত্তরা।
কবে নাগাদ শতভাগ ট্রেন সিডিউল ঠিক হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে মহাপরিচালক বলেন, ‘কোন কালেই ১শ’ ভাগ ট্রেন চলাচল ছিল না। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ১শ’ নম্বরের পরীক্ষায় কোন পরীক্ষার্থী ১শ’ নম্বর পায় না।’
তিনি আরো জানান, দুই হাজার ৮শ’ ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ১ হাজার ৪২ টি ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট তদন্ত জোরদার করতে ৮ হাজার ৩২৮ জন আনসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি র্যাব ও পুলিশও রয়েছে তৎপর। তবে নাশকতার সঙ্গে রেলওয়ের কর্মী জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগও পাওয়া যায়নি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান।
মহাপরিচালকের এই বক্তব্যকে বিরোধিতা করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের অপর এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণ মানুষের পক্ষে এত দ্রুত রেললাইন তুলে ফেলা সম্ভব নয়। এছাড়া লাইনটি তোলার জন্য ফ্লিশপ্লেট ও রেলক্লিপ খোলা হয়। এজন্য বিশেষ ধরনের যন্ত্র দরকার; যা সাধারণ মানুষের কাছে থাকার কথা নয়।
মঙ্গলবার রাজধানীর কমলাপুর স্টেশন সরেজমিনে ও সংশ্লিষ্টদের কথা বলে এসব চিত্র পাওয়া গেছে। এ সময় জানা গেছে, সকাল ৯টার ট্রেন ছাড়া হচ্ছে সকাল ১১টায়। কোন কোন ট্রেনের আবার সঠিক সময়ে ছেড়ে যাচ্ছে । তবে ট্রেন সিডিউল বিপর্যয় আগের থেকে অনেকটা কমেছে বলে যাত্রীরা জানান। দিনের থেকে রাতের ট্রেনের সিডিউল ঠিক নেই। রাত ৯ টার ট্রেন ছাড়ে রাত ১১টায়। এ সময় ট্রেন বিপর্যয়ের কারণে শিশু-বৃদ্ধসহ পরিবার নিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রেলওয়ে যাত্রীদের।
উত্তরাঞ্চলগামী লালমনি এক্সপ্রেসের যাত্রী মনতাজুল ইসলাম বলেন,‘ রংপুর যাওয়ার জন্য গত সোমবার রাত নয়টায় প্ল্যাটফর্মে এসেছেন। ট্রেনটি সোমবার রাতেই ছাড়ার কথা ছিল। কিন্তু মঙ্গবার সকাল ১১ টায় ছেড়েছে।’
কমলাপুর স্টেশন সূত্র জানায়, রংপুর এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা ছিল সকাল নয়টায়। ধূমকেতু এক্সপ্রেস ভোর ছয়টায় ছাড়ার কথা ছিল। এর কোনটিই সময় মত কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যায়নি। রাজশাহী এক্সপ্রেস, সুন্দরবন এক্সপ্রেস, মহানগর প্রভাতী, পারাবতসহ সব ট্রেনেই চলছে সিডিউল বিপর্যয়। তবে ঢাকার আশপাশে চলাচলকারী ট্রেন আসতে বা যেতে খুব বেশি দেরি হচ্ছে না।’
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে নাশকতা। এ পর্যন্ত ২৭৭টি নাশকতার ঘটনা ঘটলেও সেটা এড়ানোর কোন চেষ্টা নেই রেলওয়ের। এসব নাশকতার নেপথ্যে রেলওয়ের নিজস্ব কর্মীরাই জড়িত বলে মনে করছেন সংস্থাটির বিশেষজ্ঞ মহল।
রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০১৩ সালের বিভিন্ন সময় নাশকতার বড় আঘাত আসে রেলওয়ের ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে। এর মধ্যে অতি সম্প্রতি এ পথের ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুর ও কুমিল্লায় এ পর্যন্ত চার দফা ফ্লিশপ্লেট ও লাইন খুলে ফেলা হয়। এর মধ্যে অবরোধ শুরুর ওই সময় রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় কসবা ও ইমামবাড়ী স্টেশনের মধ্যে ৬৬৮ ফুট লাইন (এক কিলোমিটারের বেশি) তুলে পানিতে ফেলে দেয়া হয়।
রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, মাত্র ৪০ মিনিটে কসবা ও ইমামবাড়ী স্টেশনের মধ্যে এক কিলোমিটারের বেশি রেললাইন তুলে ফেলা হয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে এত দ্রুত রেললাইন তুলে ফেলা সম্ভব নয়। এজন্য বিশেষ ধরনের যন্ত্র দরকার; যা সাধারণ মানুষের কাছে থাকার কথা নয়।
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর থেকেই মূলত রেল যোগাযোগে নাশকতা শুরু। দীর্ঘ সময়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেও রেলের নিরাপত্তা সংক্রান্ত জরুরি উল্লেখিত তিন ব্যবস্থা কার্যকর করেনি রেলের প্রকৌশল বিভাগ।
এ ফলে সারাদেশে ট্রেনের সময়সূচি ভেঙে পড়ে। আয়ও নেমে আসে অর্ধেকে।
রেলওয়ের পরিচালক (ট্রাফিক) সৈয়দ জহুরুল ইসলাম জানান, গত কয়েক দিনের নাশকতার সঙ্গে রেলওয়ের কর্মীরা যুক্ত থাকতে পারেন। কারণ রেলে ট্রেড ইউনিয়ন আছে। এসব ইউনিয়নে বিভিন্ন মতাদশের শ্রমিক রয়েছেন। তারা এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। সাধারণ মানুষ ফিপ্লেট বা লাইন খুলতে পারলে সব স্থানে এ চেষ্টাই করা হতো। রেলপথ আটকে অবরোধ করার প্রয়োজন হতো না।