মোঃ মাসুদ রানা রাশেদ, লালমনিরহাট থেকে :
দেশীয় প্রযুক্তিতে ব্যয় সাশ্রয়ী উদ্ভাবনের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগের বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন) তাসরুজ্জামান বাবু।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্টেভি এওয়ার্ড ইনকর্পোরেশন থেকে ‘মোস্ট ইনোভেটিভ টেকনোলজি লিডার অভ দ্য ইয়ার’ ক্যাটাগরীতে ‘সিলভার এশিয়া-প্যাসিফিক স্টেভি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’ পদক বিজয়ী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা করা হয়েছে।এছাড়াও একই ক্যাটাগরীতে সহবিজয়ী হিসেবে গুগল, অ্যামাজনসহ আরও কিছু খ্যাতনামা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্ট উদ্ভাবকও রয়েছেন।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে ‘কঞ্জুমার্স প্রোডাক্টস ইন্ডাস্ট্রিজ’ ক্যাটাগরীতে সুপার স্টার গ্রুপ, ২০২২ সালে ‘এক্সিলেন্স ইন ইনোভেশন ইন ফিনানশিয়াল ইন্ডাস্ট্রি’ ক্যাটাগরীতে নগদ, ২০২৫ সালে ‘ফেভারিট কাস্টমার সার্ভিস’ ক্যাটাগরীতে ডিএইচএল এক্সপ্রেস ওয়ার্ল্ড ওয়াইড (বিডি) প্রাঃ লিঃ এই পদক লাভ করলেও ‘মোস্ট ইনোভেটিভ টেকনোলজি লিডার অভ দ্য ইয়ার’ ক্যাটাগরীতে এবং ব্যক্তি হিসেবে তাসরুজ্জামান বাবু প্রথম বাংলাদেশী যিনি এই পদক লাভ করলেন।
অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগে বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (ক্যারেজ এন্ড ওয়াগন) হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বেশ কয়েকটি উদ্ভাবন করে আলোচনায় আসেন এই প্রকৌশলী। তাঁর মধ্যে গত ১৭ মে দৈনিক প্রথম আলোতে তাঁর উদ্ভাবিত দেশের একমাত্র অটোমেটেড টার্নটেবিল এর সংবাদ প্রকাশিত হয় “দেশে প্রথম তৈরি হলো রেলের ইঞ্জিন ও কোচ ঘোরানোর টার্নটেবিল” শিরোনামে। অন্যান্য অনলাইন, প্রিন্ট ও টিভি চ্যানেলেও উক্ত সংবাদটি ফলাও করে প্রচার করা হয়। এছাড়াও তিনি ভাঙ্গন প্রতিরোধী দীর্ঘ স্থায়ী হুইলসেট গাইড, রেল দুর্ঘটনায় কোচ ও লোকোমোটিভ উদ্ধার কাজে ব্যবহার্য রি-রেইলিং ইকুইপমেন্টস, লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের কোচের শিডিউল মেরামত করার জন্য প্রথম ইলেকট্রিক লিফটিং জ্যাক স্থাপনসহ বেশ কিছু ছোট-বড় উদ্ভাবন করেন। তাঁর উদ্ভাবিত অটোমেটেড টার্নটেবিল (যেটিকে অনেক রেল প্রকৌশলী দক্ষিণ-এশিয়ার প্রথম অটোমেটেড টার্নটেবিলও বলছেন) এর জন্য ২০২৪ সালে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে তিনি শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবকের স্বীকৃতি পান। তাঁর এই উদ্ভাবনের কারণে জাতিসংঘের শিল্প উন্নয়ন সংস্থা (UNIDO) ও জার্মানির Senat der Wirtschaft থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে SDG Innovation Award 2024 এর স্বীকৃতি সনদ লাভ করে।
স্টেভি অ্যাওয়ার্ড (Stevie Award) একটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অন্যতম সর্বাধিক সম্মানজনক প্রিমিয়ার বিজনেস অ্যাওয়ার্ড, যা ২০০২ সাল থেকে বিশ্ব ব্যাপী ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ভাবন ও অর্জনের জন্য ৯টি প্রোগ্রামে বেশ কিছু ক্যাটাগরীতে প্রদান করা হয়। প্রোগ্রামগুলো হলো: এশিয়া-প্যাসিফিক স্টেভি অ্যাওয়ার্ডস, দি জার্মান স্টেভি অ্যাওয়ার্ডস, দি মিডল ইস্ট এন্ড নর্থ আফ্রিকা স্টেভি অ্যাওয়ার্ডস, দি আমেরিকান বিজনেস অ্যাওয়ার্ডস, দি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অ্যাওয়ার্ডস, দি স্টেভি এওয়ার্ডস ফর গ্রেট এমপ্লয়ার্স, দি স্টেভি এওয়ার্ডস ফর উইমেন ইন বিজনেস, দি স্টেভি অ্যাওয়ার্ডস ফর সেলস এন্ড কাস্টমার সার্ভিস, এবং দি স্টেভি অ্যাওয়ার্ডস ফর টেকনোলজি এক্সিলেন্স। এর আগে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও ক্যাটাগরীতে Google, IBM, Tesla, Amazon, Adobe, Starbucks-এর মতো প্রতিষ্ঠান এবং LinkedIn-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা রেইড হফম্যানসহ আরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই পুরস্কার পেয়েছেন।
বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশের ১২,০০০ এর বেশি মনোনয়নের মধ্যে থেকে তাসরুজ্জামান বাবু এই পদক এর জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। আগামী ১৩ মে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের লোটে হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের হাতে পদক তুলে দেওয়া হবে। এই পদক লাভের বিষয়ে তাসরুজ্জামান বাবুর অভিব্যক্তি জানতে চাইলে তিনি বলেন, “নিঃসন্দেহে ভালো লাগছে। এত বড় বড় রথি-মহারথিরা যে এই পদক পেয়েছেন তা আগে জানলে আবেদন করারই সাহস পেতাম না! স্বল্প খরচে, দেশীয় প্রযুক্তি ও কারিগরী জ্ঞান ব্যবহার করে করা এই সব ছোট খাট উদ্ভাবনই তুলনামূলক অনগ্রসর ও ১২২ বছরের পুরাতন লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের কাজের পরিবেশ বদলে দিয়েছে। আমার উদ্ভাবনগুলোতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব প্রযুক্তিতে নিজস্ব সমাধান বের করে নেওয়ার যে মেসেজ ছিল তা জুরি বোর্ড অত্যন্ত পছন্দ করেছেন বলে আমাকে এই পদকের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে।”
তাসরুজ্জামান বাবু ৩৫তম বিসিএস এর মাধ্যমে একজন ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েতে সহকারী যান্ত্রিক প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে তিনি ইনস্টিটিউট অভ মেরিন টেকনোলজি বাগেরহাট, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেড, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানায় চাকরী করে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত এই প্রকৌশলীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা চাঁপাইনবাবগঞ্জে। শিক্ষা জীবনে তিনি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক, এবং ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি এশিয়ান ডেভেলমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে প্রদত্ত এডিবি-জেএসপি স্কলারশি নিয়ে জাপানের ন্যাশনাল গ্রাজুয়েট ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ (গ্রিপ্স) থেকে পাবলিক পলিসিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
সরকারি চাকরীর পাশাপাশি তাসরুজ্জামান বাবু দুই বাংলার একজন জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞান লেখক। বিভিন্ন সময় তাঁর লেখা দেশের প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক ও মাসিকগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর পাঠক সমাদৃত বইগুলো বাংলাদেশ থেকে প্রকাশ করেছে সময় প্রকাশন। এছাড়াও কিছু বইয়ের ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বইচই প্রকাশন ও খোয়াই পাবলিশিং হাউজ থেকে।