ভুয়া সাংবাদিকদের ভয়ঙ্কর প্রতারণা: ত্যক্ত-বিরক্ত-বিব্রত গাজীপুর

বিশেষ প্রতিবেদন
যৌণকর্মি, ভবঘুরে, মাদক ব্যবসায়িসহ পেশাদার অপরাধীদের গলায় গলায় ঝুলছে রিপোর্টার আইডি! পেটে বোমা মারলেও দু’লাইন লেখার যোগ্যতা নেই, অথচ রিপোর্টার পরিচয়ে তারাই খুলে বসেছে বহুমুখী প্রতারণার বাণিজ্য। চিহ্নিত দেহব্যবসায়িকে সহযোগী বানিয়ে প্রশাসনিক সহায়তা জুটিয়েই গড়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট। তাদের অব্যাহত ব্ল্যাকমেইলিং আর নানা হয়রানির ধকলে গাজীপুরবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ভূয়াদের অপ্রতিরোধ্য দৌরাত্ম্যে প্রকৃত সাংবাদিকরা যেমন বিব্রত, তেমনই ত্যক্ত বিরক্ত প্রশাসন। এরা প্রায়ই থানার দারোগাদের সাথে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডাবাজিতে মত্ত থাকে। পুলিশের ‘সোর্স’ হিসেবে তারা বিশ্বস্ত, ঘুষ বাণিজ্যেরও সহায়ক! গাজীপুরের কাশিমপুর থানার সামনেই চিহ্নিত চাঁদাবাজরা রীতিমত সাংবাদিক অফিস স্থাপন করে বসেছে। থানায় আসা যাওয়া ভুক্তভোগী মানুষজনকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেনস্তা করা, আসামি ধরানো-ছাড়ানো, বিচার শালিসের মাধ্যমে যে কোনো অপরাধের মিট মিমাংসা করিয়ে দেওয়ার মতো জঘণ্য দালালিতে মেতে উঠেছে তারা। তাদের অব্যাত অত্যাচারের মুখে সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষজন থানায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে রীতিমত আতংকে ভুগেন।
গাজীপুর জুড়ে সাংবাদিকতার নামে চলছে ভয়ঙ্কর সব কাজ কারবার। চিহ্নিত অপরাধীরা বুকে পিঠে রিপোর্টার আইডি ঝুলিয়ে বহুমুখী প্রতারণায় নেমে পড়েছে। এ ধরনের বেশ কয়েকটি চক্র গোটা গাজীপুরকে গিলে খেতে শুরু করেছে। তারাই নিরীহ লোকজনকে নানাভাবে হয়রানি করছে বলেও এন্তার অভিযোগ উঠেছে। সাংবাদিক পরিচয়ে এরা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখল, দোকানপাট দখল, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে জড়িত হয়ে পড়ছে। এই চক্রে বিতর্কিত নারী সদস্যও থাকেন। এরা মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসে ‘প্রেস’ কিংবা ‘সংবাদপত্র’ লিখে পুলিশের সামনে দিয়েই নির্বিঘ্নে দাবড়ে বেড়ায়। এদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও বিভিন্ন যানবাহনও থাকে চোরাই এবং সম্পূর্ণ কাগজপত্রবিহীন। ভুয়া সাংবাদিক আর কথিত মানবাধিকার কর্মিদের নানা অপকর্মের কারণে প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিকদের ভাবমূর্তি এখন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
রাজধানীতে মিরপুরের পরেই ভূয়া সাংবাদিকদের সবচেয়ে বেশি দৌরাত্ম্য রয়েছে সমগ্র গাজীপুর জুড়ে। কথিত সাংবাদিকরা নানা সিন্ডিকেটে বিভক্ত হয়ে অভিনব সব কৌশলে প্রতারণা চালিয়ে আসছে। প্রতিটি সিন্ডিকেটের পক্ষ থেকেই তথাকথিত ‘অনলাইন নিউজ পোর্টাল’ তৈরি করে তার আওতায় নিজেদের আইডি কার্ডও বানিয়ে নেয় তারা। গন্ডমূর্খ একেকজন রাতারাতি চীফ রিপোর্টার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, নিউজ এডিটর, এডিটর পদবী ধারন করে রঙবেরঙের ভিজিটিং কার্ড বিলিয়ে বেড়ান, যত্রতত্র গড়ে তোলেন প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ক্লাব, ক্রাইম রিপোর্টার্স সোসাইটি ইত্যাদি নামের ভূইফোড় সংগঠন। এসব সংগঠনের ব্যানারেও চলে নানা অজুহাতের চাঁদাবাজি।
বৃহত্তর গাজীপুরে নানা নামে ২৯টি সাংবাদিক সংগঠন, সমিতি, ক্লাব গড়ে উঠেছে, এছাড়াও রিপোর্টার্স ক্লাব, সাংবাদিক ক্লাব, ক্রাইম রিপোর্টার্স সোসাইটি, বৃহত্তর গাজীপুর সাংবাদিক ফোরাম ইত্যাদি সংগঠন, এসোসিয়েশন, ক্লাব, সমিতির সংখ্যা দেড় ডজন ছাড়িয়ে গেছে। কাশিমপুর প্রেসক্লাব সেক্রেটারী মাজহারুল ইসলাম প্রতীক ও তার ভাই তরিকুল জুয়েল ও আব্দুল কুদ্দুস থানার পাশেই গড়ে তুলেছেন ‘সাংবাদিক অফিস’ নামের অভিনব সিন্ডিকেট কার্যালয়। সেখান থেকেই মিল-কারখানা, ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ, মাদক ব্যবসায়ীসহ অপরাধ আখড়াগুলোতে অবাধ চাঁদাবাজি চালানো হয়। ওই সাংবাদিক অফিসের নানারকম অপতৎপরতার কারণে ভুক্তভোগী মানুষজন থানায় যাতায়াতের ক্ষেত্রেও আতংকে ভুগেন। সাধারণ জিডি করতে গেলেও সাংবাদিক ক্লাবের চিহ্নিত চাঁদাবাজদের নানামুখী প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়। তাছাড়া ভুক্তভোগীদের মামলা করিয়ে দেওয়া, মামলা থেকে আসামীর নাম কেটে দেওয়া, আসামী ধরানো-ছাড়ানো, যে কোনো অভিযোগের মিট-মিমাংসা করানোর শালিস দরবার পরিচালনার মতো দালালি কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকছেন সাংবাদিক অফিসের চাঁদাবাজরা।
কথিত সাংবাদিক অফিসের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন সেখানকার ভূমি কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ মিয়াসহ ভুক্তভোগিরা। তারা বলেছেন, গাজীপুরের কাশিমপুরে সাংবাদিক অফিসের ভাড়া বাবদ মাসোহারা না দেওয়ায় মিথ্যা, বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রকাশ করাসহ নানারকম ভয়ভীতি প্রদর্শণ করা হচ্ছে।
প্রাপ্ত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ২০ এপ্রিল ৬ নং ওয়ার্ড ভূমি অফিসে গিয়ে চার ব্যক্তি কথিত সাংবাদিক অফিসের নামে ঘর ভাড়ার টাকা দাবি করেন। তারা বলেন, প্রতি মাসে অফিস ঘরের ভাড়া বাবদ চার হাজার টাকা করে পরিশোধ না করলে নানারকম হয়রানি পোহাতে হবে। কিন্তু ভূমি অফিসের নায়েব আব্দুল লতিফ মিয়া মাসোহারার চাঁদা দিতে অস্বীকার করতেই বিভিন্ন অনলাইনে একের পর এক কল্পিত সংবাদ প্রচার করছে চক্রটি।
পান থেকে চুন খসলেই…
সাংবাদিকদের মতো বেশভূষায় সেজেগুজে একশ্রেণীর প্রতারক অলিগলি, হাট-বাজার চষে বেড়াচ্ছেন। পান থেকে চুন খসলেই রীতিমত বাহিনী নিয়ে হামলে পড়েন সেখানে। প্রকৃত ঘটনা কি- সে ঘটনার আদৌ কোনো নিউজ-ভ্যাল্যু আছে কি না, সেসব ভেবে দেখার ফুসরৎ তাদের নেই।
তাদের দরকার নিজেদের প্রতাপ দেখিয়ে, আতংক ছড়িয়ে টুপাইস কামিয়ে নেয়া। টাকা পকেটে না আসা পর্যন্ত চিল্লাপাল্লা, হুমকি, ভীতি প্রদর্শনের সব কান্ডই ঘটিয়ে থাকেন তারা।
থানা সদর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত পল্লীর সাধারণ বাসিন্দারা পর্যন্ত কথিত সাংবাদিক কার্ডধারী ভূয়াদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।
থানা ঘিরেই যত জটলা একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রস্তুতের নিমিত্তে গত কয়েকদিন গাজীপুর জেলার বিভিন্ন থানা প্রাঙ্গনে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তথ্যানুসন্ধানকালে এক হতাশাব্যঞ্জক চিত্রই বেরিয়ে আসে।
সাংবাদিক ও কথিত মানবাধিকার সাংবাদিক নামের কার্ডধারীরা থানা-পুলিশের দালালি ও তদবির কার্যক্রমেই ব্যস্ত থাকেন সদা সর্বদা। অনেকে বুকে পিঠে রিপোর্টারের কার্ড ঝুলিয়ে প্রকাশ্যেই পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি’র সোর্সের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। সন্ধ্যার পর একেকটি থানা চত্বরে, আশপাশের চা দোকানে, দারোগারে টেবিলে টেবিলে ১৫/২০ জন কথিত সাংবাদিকের জটলা থাকে। থানা, ফাঁড়ি, পুলিশ ষ্টেশন কেন্দ্রিক তথাকথিত সাংবাদিক ও মানবাধিকার তদন্ত কর্মকর্তাদের সংখ্যা কত? তা হিসেব কষে বলা মুশকিলই বটে। থানায় থানায় গভীর রাত পর্যন্ত পুলিশ কেন্দ্রিক কি কাজ তাদের? সেসব প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলে না।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫